গত এক যুগেরও বেশি সময় পর স্মরণকালের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের ফলে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে রাজশাহী মহানগরবাসী। যেন স্থবির হয়ে পড়েছে রাজশাহীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। টানা ভারী বর্ষণে এরইমধ্যে তলিয়ে গেছে মহানগরীর নিম্নাঞ্চল। মহানগরীর অধিকাংশ এলাকায় হাঁটুপানি দেখা দিলেও কিছু এলাকায় কোমরপানিতে ভাসছে মূল শহর ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকে সড়কেই জাল ফেলে ভেসে আসা মাছ শিকার করছেন। আর সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে অফিসগামীদের যান হিসেবে মূল শহরের ব্যস্ততম সড়কে ব্যবহৃত হয়েছে নৌকা। এর আগে নগরবাসী এমন চিত্র দেখেছে বলে জানাতে পারেনি। যদিও এ বৃষ্টিকে কৃষির জন্য আশীর্বাদ হিসেবেই দেখছে কৃষি অধিদপ্তর। আর এই বৃষ্টি রোপা-আমনের জন্য সুফল বয়ে আনলেও মাছচাষীরা পড়েছে বিপাকে। তাদের কাছেও বৃষ্টিপাত কাঙ্খিত থাকলেও অতিমাত্রায় বর্ষণ হওয়াতে অনেক পুকুর ভেসে গেছে। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভাষ্য মতে, বুধবার (৪ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। আর বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল ৫টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বৃষ্টি চলছিল। বুধবার রাত থেকে শুরু হওয়া চলমান বৃষ্টির অধিকাংশ সময়ই মুষলধারে চলেছে। এমন বৃষ্টি গত এক যুগেরও বেশি সময় দেখেনি এই পদ্মাপাড়ের মানুষ। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার দুপুর ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত) রাজশাহীতে ২৪৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি বছর তো বটেই, স্মরণকালের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। একদিনে এ পরিমাণ বৃষ্টিপাত গত ১২ বছরের (এক যুগ) রেকর্ডে নেই। এর আগে ২০২১ সালের ২০ জুলাই রাজশাহীতে ১১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। তার আগে ও পরে অক্টোবরের এ বৃষ্টিপাতই সর্বোচ্চ। তবে চলমান অতিবর্ষণটি শুক্রবার (৬ অক্টোবর) সকাল থেকে কিছুটা কমতে শুরু করবে বলেও জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিস। এদিকে স্মরণকালের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে ভাসছে রাজশাহী শহর। বিশেষ করে শহরের নিম্নাঞ্চলে ঘর-বাড়িতে বৃষ্টির পানি ঢুকে গেছে। মূল শহর এবং মধ্যাঞ্চলে হাঁটুপানি জমে গেছে। অবিরাম বর্ষণে চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে। মহানগরীর সড়ক ঘেঁষে থাকা ড্রেনের পয়ঃনিষ্কাশনের নোংরা পানিগুলো বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গেছে। আর এই নোংরা পানি মানব শরীরের জন্য চর্মরোগের সৃষ্টি করতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চিকিৎসকগণ। তবে মূশলধারে হওয়া বৃষ্টিপাতটি আনুমানিক তিন ঘন্টা না হলেই নগরীর অসস্তিকারক জলাবদ্ধতা কেটে যাবে বলে অভিমত নগরবাসীর। আর এই জলাবদ্ধতার সমস্যা এবারই হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। রাজশাহীতে মাত্র আধাঘন্টা বৃষ্টি হলেই এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। যুগ যুগ ধরে চলছে এমন দুর্ভোগ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সৌন্দর্যবর্ধনের মতো অভূতপূর্ব উন্নয়নে গ্রীনসিটি বা ক্লিন সিটির তকমা পেলেও বর্ষণমুখর দিনগুলোতে রাজশাহী নগরীর রাস্তাঘাটে জলাবদ্ধতার সেই পুরোনো দৃশ্যই দৃশ্যমান বারবার। রাজশাহী শহরে কয়েক হাজার কোটির টাকার উন্নয়ন কাজ হলেও আজও হয়নি জলাবদ্ধতা নিরসন। এবার কদিন পর পরই বৃষ্টি ঝরছে তাপদাহ খ্যাত উত্তরের এই নগরীতে। আর তাই জলজট নিয়েও দুর্ভোগ কাটছে না নগরবাসীর। এতে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটছে। বহুল আকাঙ্খিত বৃষ্টি রূপ নিয়েছে জনদুর্ভোগে। আষাড়ে নয়, আশ্বিনের এ টানা বৃষ্টিতেই দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। পথঘাট ডুবে যাওয়ায় মোটরসাইকেল, রিকশা, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন হালকা ও ভারী যানবাহন চলাচলে ব্যাপক বিঘœ ঘটছে। পানির নিচে থাকা বিভিন্ন সড়কে খানাখন্দকের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনাও। বৃহস্পতিবার সকালে এবং দুপুরেও নগরী ঘুরে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতার এ বেহাল চিত্র। বিশেষ করে নগরীর চিকিৎসাসেবার জন্য ব্যস্ততম লক্ষ্মীপুর, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল চত্বর, ঝাউতলা মোড়, ভাটাপাড়া ছাড়াও নগরীর মূল সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট, গণকপাড়া, তালাইমারী মোড়, শিরোইল মাস্টারপাড়া, হেতমখাঁ, কাদিরগঞ্জ, বর্ণালী মোড়ের পেছনে, আমবাগান, তেরোখাদিয়া, কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার সামনে, রাজশাহী পর্যটন মোটেল রোড, সপুরা গোরস্থানের মোড় থেকে উপশহর মোড়, গৌরহাঙ্গা রেলগেইট, পলিটেকনিক ইনস্ট্রিটিউট মোড়, শালবাগান, মালদাহ কলোনি, কয়েরদ্বারাসহ অনেক এলাকায় বৃষ্টির পানি হাঁটু কোথাও কোথাও কোমর পর্যন্ত জমে যাওয়ায় এসব এলাকায় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানিতে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়, কোর্ট চত্বরে জমেছে হাঁটুপানি। সকাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরগুলোতে পানি মাড়িয়ে কর্মকা- পরিচালনা করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই। বৃষ্টি হলেই রাজশাহী শহরের অনেক রাস্তায় পানি জমে যায়। আর পাড়া-মহল্লার ছোট রাস্তায়ও জমে গেছে হাঁটুপানি। তাই বৃষ্টি হলেই সড়কের জলাবদ্ধতা নিয়ে চরম আশঙ্কায় থাকেন নগরবাসী। কারণ সবাইকেই পড়তে হয় চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে। তবে বৃষ্টি থামার ৩/৪ ঘণ্টার মধ্যেই এসব এলাকার সড়কের পানি নেমে যায়। কিন্তু এ বিরামহীন বৃষ্টিতে জনদুর্ভোগ অনেকটা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। পানি একদিক দিয়ে নামছে আবার আরেক দিক দিয়ে জমছে। ডুবছে সড়ক। আর কাল-পরশু বৃষ্টি থামলেও এসব নিচু এলাকার পানি নামতে এক থেকে দুই সপ্তাহ লেগে যাবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সড়কে তাই জলজটের কারণে যানজটও লেগেই থাকবে। আর আজও বৃষ্টি থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজশাহীতে ২৪৪ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি মৌসুম তো বটেই স্মরণকালের মধ্যেও সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এর আগে ২০২১ সালের ২০ জুলাই রাজশাহীতে ১১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর একদিনে এ পরিমাণ বৃষ্টি আর হয়নি। আর চলতি মৌসুমের বৃষ্টিপাতের মধ্যে ২৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজশাহীতে ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। এরপর ১ অক্টোবর ১৩ দশমিক ৫, অক্টোবর ০ দশমিক ৬ এবং ৪ অক্টোবর ১১ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে রাজশাহীতে। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ১১ থেকে ২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে মাঝারি ধরনের বর্ষণ বলা হয়। ২৩ থেকে ৪২ মিলিমিটার পর্যন্ত মাঝারি ভারী বর্ষণ হিসেবে ধরা হয়। ৪৩ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে তাকে ভারী বর্ষণ বলা হয়। আর ৮৮ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে তা অতি ভারী বর্ষণ হিসেবেই বিবেচিত হয়। তাই রাজশাহীতে অতিভারী বর্ষণ চলছে। সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ বর্ষণ চলছে। এ ছাড়া আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দেশের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিলিমিটার বা তারও বেশি) বৃষ্টিপাত হতে পারে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এদিকে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোজদার হোসেন জানান, এ বৃষ্টি কৃষি ও কৃষকের জন্য অকাঙ্খিত ছিল। আশ্বিনা বর্ষণ রাজশাহী অঞ্চলের মাঠে থাকা রোপা-আমন ধানের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। রাজশাহীতে বর্তমানে ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা-আমন ধান রয়েছে। এ সময় বৃষ্টি হওয়ায় জমিতে সেচ দেওয়া নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তা কেটেছে। এ বৃষ্টি রোপা-আমনের জন্য সুফল বয়ে আনবে। মোজদার হোসেন আরও বলেন, পানির অভাবে এতদিন যারা পাট জাগ দিতে পারছিলেন না তারা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। যদিও পাটযজ্ঞের কাজ প্রায়ই শেষ হয়ে গেছে। বৃষ্টির কারণে খাল-বিল ভরে যাওয়ায় তারা পর্যাপ্ত পানিতে এখন পাট পঁচাতে (জাগ) পারবেন। এ ছাড়া দীর্ঘ দিনের অনাবৃষ্টিতে রাজশাহীর অঞ্চলের পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে থাকলেও এ বৃষ্টিতে পানির লেয়ারও রিচার্জ হবে। যার সুফল কৃষকসহ সব মানুষই ভোগ করতে পারবেন। তবে বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হলে জমিতে থাকা মাসকালাইয়ের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। এ প্রতিবেদন লেখা অবস্থায় মুঠোফোনে সংযোগ করতে না পারায় বৃষ্টিপাতের সবশেষ পরিমাণ ও মাছচাষীদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জানা সম্ভব হয়নি।