ভোটের আনুষ্ঠানিকতা শুরু না হলেও বরিশালের ছয়টি আসনের তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনী হাওয়া এখন তুঙ্গে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের একাধিক সম্ভ্রাব্য প্রার্থী সরকারের উন্নয়ন প্রচারের মাধ্যমে নির্বাচনী গণসংযোগে মাঠে নেমেছেন। তবে প্রতিটি আসনেই ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে অভ্যন্তরীন কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে।
বিশেষ করে বিভিন্ন দল থেকে সদ্য যোগদান করা ও ক্ষমতার আমলে পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করা নেতাদের সাথে দলের দুর্দীনের ত্যাগী, নির্যাতিত ও অসংখ্য মামলায় কারাবরনকারী নেতাদের বিরোধ এখন চরম আকার ধারন করেছে। এনিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকটি আসনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়েছে। নির্বাচনের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে হাইব্রিড আওয়ামী লীগের নেতৃত্বস্থানীয় নেতারা দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে দুর্দীনের ত্যাগী নেতাদের বিভিন্ন মাধ্যমে দমন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করাসহ নানাপ্রভাকান্ড ছড়িয়ে এখন বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপপ্রচার।
যারকারণে বেশ সুবিধাজনক অবস্থান করে নিচ্ছেন বিরোধী দলের নেতারা। তারা আওয়ামী লীগের মধ্যে থাকা অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে ত্যাগী নেতাদের দমনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এতে করে একদিকে যেমন তারা চলমান আন্দোলনের নামে মাঠ গুছিয়ে নিচ্ছেন, অপরদিকে কৌশলে ক্ষমতাসীন দলের ত্যাগী নেতাদের দমন করে নৌকার প্রার্থীর সুনাম বিনস্ট করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পদমর্যাদায় থাকা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের কারণে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে এখানে কোন প্রার্থী নেই। তবে টানা ক্ষমতার আমলে এখানে সবচেয়ে বেশি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘটনা ঘটেছে। তাই বরিশালের ছয়টি আসনের মধ্যে বর্তমানে এখানে সবচেয়ে বেশি দলীয় বিরোধ রয়েছে। হামলা ও মামলার পর যা এখন বড়ধরনের সংঘাতের রূপ নিয়েছে। পাশাপাশি নেতৃত্বস্থানীয়দের প্রতিটি কর্মকা- আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর জনপ্রিয়তাকে বির্তকিত করছে।
অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে দলীয় বিরোধ সৃষ্টি করায় দলের ত্যাগী নেতারা হামলা ও মামলার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকে আত্মগোপন এবং কেউবা অভিমান করে রাজপথে না থাকায় অত্যন্ত সু-কৌশলে মাঠ গুছিয়ে সক্রিয় হচ্ছেন বিএনপির সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন ও দলের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবাহান।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনের বর্তমান সাংসদ শাহে আলম নিজ দলের মধ্যেই এবার বেশ ঝুঁকিতে রয়েছেন। ক্ষমতার পাঁচ বছরে তিনি দলে কোন শক্ত অবস্থান করতে পারেননি। ফলে এ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এবার প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছেন। ওই আসনে মনোনয়ন পেতে মাঠে রয়েছেন সাবেক এমপি মনিরুল ইসলাম মনি এবং বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি ও জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের সভাপতি ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন।
ক্ষমতাসীন দলের বাহিরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু অত্যন্ত সু-কৌশলে দলগুছিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশ জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিচুজ্জামান আনিচও তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
আওয়ামী লীগের এমপি নেই বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে। এখনকার এমপি জাতীয় পার্টির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। এবার জোট-মহাজোট মিলে বর্তমান সাংসদকে ধরাশায়ী করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এখানে এবার আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ঘোষণা করার জন্য দীর্ঘবছর থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের সমর্থিত প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা ও বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক সরকারের উন্নয়ন প্রচারনায় মাঠে রয়েছে।
এ আসনটিতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক এমপি শেখ টিপু সুলতান প্রার্থী হতে বেশ আগ্রহী। তবে এ আসনটিতে এবার আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী ঘোষণা করা না হলে আসনটি মহাজোটের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার দৌঁড়ে বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী হতে পারেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা শাহে আলম মুরাদ ও বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আফজালুল করিম। এর বাইরে বিএনপির সাবেক এমপি মেজবাউদ্দিন ফরহাদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানও কৌশলে মাঠ গোছাচ্ছেন।
বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বর্তমান এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীমের প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী হওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে এবার মাঠে নেমেছেন বিদায়ী সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। এখানে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছেন বিএনপির চারবারের এমপি মজিবর রহমান সরোয়ার, জাপার ইকবাল হোসেন তাপস ও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির ফয়জুল করীম।
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনের বর্তমান এমপি জাপার নাসরিন জাহান রতœাকে পরিবর্তন করতে এককাট্টা হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা এবার এককভাবে নৌকার প্রার্থী চাচ্ছেন। এখানে মনোনয়ন পাওয়ার দৌঁড়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ মল্লিক, বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এসএম মঞ্জুরুল হক মঞ্জু, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বাদশা, বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সামসুল আলম চুন্নু, সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়া।
ক্ষমতাসীনদের বাহিরে এখানে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক সাংসদ আবুল হোসেন খান, জেলা বিএনপির সাবেক সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান রাজন। জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ মোহসীন। সবমিলিয়ে এখনই ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীন বিরোধ মীমাংসা করে ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের সরকারের উন্নয়ন প্রচারনার জন্য রাজপথে নামানো না হলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিরুপ প্রভাব পরার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।