প্রায় আড়াই বছর আগে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে যোগদান করেছেন মো. দুলাল আলম। এরপর থেকেই নিয়মিত অফিসে না আসা, জাতীয় দিবস পালদে উপস্থিত না থাকা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকরা অফিসে না পেয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হওয়াতে মনমানসিকতা ভালো না থাকায় একটু এলোমেলো হয়।
তবে তিনি এসবকে পুঁজি করে অফিস ফাঁকি দিলেও দুলাল আলম ব্যপক অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ ও শোকজ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিমাসে শিক্ষক কর্মচারীদের নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ শিক্ষক-কর্মচারীদের। তার ঘুষ বাণিজ্যে শিক্ষক কর্মচারীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রধান, সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড গঠনের সময় তিনি ৬০ হতে ১ লাখ টাকা, কর্মচারী নিয়োগের জন্য ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা উৎকোচ দিতে বাধ্য করেন। নিয়োগ পাওয়ার পর ফাইল পাঠাতে শিক্ষক প্রধান, সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এনটিআরসির শিক্ষক নিয়োগের ফাইল পাঠাতে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা, নতুন কর্মচারী নিয়োগের পর ফাইল পাঠাতে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এখানেই শেষ নয়, শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেলের ফাইল পাঠাতে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা, কর্মচারীদের ১/২ হাজার টাকা বাধ্য করে ঘুষ নেয়া হচ্ছে। শূণ্যপদের প্রত্যয়ন নিতে গুনতে হয় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা।
এসব ঘুষের টাকা উত্তোলন করে থাকেন তার অফিস সহকারি আনোয়ার হোসেন। উপবৃত্তির টিউশন ফি উত্তোলনে কথিত প্রত্যয়নের জন্য আনোয়ার ঘুষ আদায় করে থাকেন ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা।
ওই অফিস সহকারির দাপটে শিক্ষকরা একরকম অসহায় হয়ে পড়েছে। ঘুষের টাকা ছাড়া কোন ফাইল নড়াচড়া করে না। এ ঘুষের টাকা না দিতে চাইলে অফিস সহকারি আনোয়ার শোকজ নোটিশ লিখে শিক্ষা কর্মকর্তার স্বাক্ষর করে ধরিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নেন হাজার হাজার টাকা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা মো. দুলাল আলমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রশ্ন করা মাত্রই ফোন কলটি দ্রুত কেটে দেন।
অফিস সহকারি আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি স্যারের নির্দেশনায় এসব টাকা নিয়ে থাকি। স্যার নিজেই যার কাছে যেমন পারে তেমন ভাবে এসব টাকা পয়সা নেন। যখন মিটিং এ থাকে তখন আমাকে নিতে বলেন। এসব টাকা নেওয়ার নিয়ম না থাকলেও এসব টাকা নেওয়া একরকম নিয়ম হয়ে গেছে। শুধু এই স্যার না এর আগেও যারা ছিলেন তারাও নিয়েছে। এছাড়াও আয়া নিয়োগে ঊর্ধ্বতন মহল ৮/১০ লাখ টাকা নেন।
এনটিআরসি থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত লস্করহাটি উচ্চবিদ্যালয়ের এক সহকারি শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার বেতনের জন্য শিক্ষা অফিসার দুলাল আলম প্রথমে ৫ হাজার টাকা চেয়েছিলো। পরে বলে ৪ হাজার টাকা নিয়েছে। আমাদের স্কুলের ৮ জন আবেদন করেছিলো মোট ১৬ হাজার টাকা নিয়েছেন। টাকা ছাড়া তিনি কাজই করেন না। উপজেলায় যতগুলো স্কুলের শিক্ষক আবেদন করেছিলো সবার কাছে তিনি টাকা নিয়েছেন। একবার তিন মাসের বেতন বকেয়া ছিলো সেটির আবেদন করলে পুনরায় টাকা নিয়েছেন বলে জানান।
হুজরাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের এক সহকারি শিক্ষক বলেন, আমার উচ্চতর বেতন করার জন্য ৯ হাজার টাকা নিয়েছেন। টাকা না দিলে ফাইল আটকে রেখে ঘুরান। তাই হয়রানি হতে বাঁচতে বাধ্য টাকা দিতে হয়েছে।
গত আগস্ট মাসে অভায়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের তারিখ জালিয়াতি করে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ওই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গেলো আগস্ট মাসে প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা উৎকোচের বিনিময়ে নিয়োগ দেন।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নিয়োগে দেওয়ার বিষয়টি রাজশাহী জেলা প্রশাসক, দুর্নীতি দমন কমিশন, রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা উপণ্ডপরিচালক, জেলা শিক্ষা অফিসার সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন বাসুদেবপুর এলাকার কুতুবুল আলম। সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান শিক্ষক সারওয়ার জাহানকে স্কুলে না পাওয়ার অভিযোগে শোকজ দেন শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলম।
পরবর্তীতে শোকজের সমাধান ও ৪ জনের বেতন ভাতার ফাইল পাঠাতে অফিস সহকারি আনোয়ার হোসেন শিক্ষা কর্মকর্তার নাম করে হাতিয়ে নেন ৬৫ হাজার টাকা। চয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন জন কর্মচারী নিয়োগে দুলাল আলম হাতিয়ে নিয়েছেন ৯৫ হাজার টাকা। শূন্য পদে প্রত্যয়ন নিয়ে ৫ হাজার টাকা, বেতন ভাতার জন্য আলাদাভাবে ঘুষ নিয়েছেন ৩০ হাজার টাকা।
পিরিজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩ জন নিয়োগ প্রাপ্তদের নিকট হতে ৫৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ললিত নগর শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নিরাপত্তাকর্মী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগের জন্য প্রধান শিক্ষক আবদুল লতিবকে না জানিয়ে সভাপতি তরিকুল ইসলাম গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিয়োগ পরীক্ষার ডেট করেন এবং তরিকুল ইসলাম শিক্ষা কর্মকর্তাকে নিয়োগের জন্য ৯৫ হাজার টাকা ঘুষ দেন। সভাপতি এককভাবে দুই প্রার্থীর নিকট হতে এমপির নাম ভাঙ্গিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ২৬ লাখ টাকা। বিষয়টি জানাজানি হলে প্রধান শিক্ষকসহ কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ নিয়োগ রেজুলেশনে স্বাক্ষর করছেন না। ফলে নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
রাজবাড়ীহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর, নৈশ্য প্রহরী, আয়া, নিরাপত্তা কর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ মোট ৫ টি পদের নিয়োগে শিক্ষা কর্মকর্তা হাতিয়ে নেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। টাকা কম দেয়ায় একবার তিনি নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হননি। পরে তিনি কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদে নিয়োগ বোর্ডের ১ লাখ টাকা অগ্রীম ঘুষ গ্রহন করে নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হয়ে সোলেমানকে নিয়োগ দেন।
হুজরাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে তিন জন কর্মচারী নিয়োগে দুলাল আলম ৯০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহন করেছেন। প্রেমতলী সুকবাসিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষকসহ ২ জন কর্মচারী নিয়োগ দুলাল আলম হাতিয়ে নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। নলত্রি নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ জন কর্মচারী নিয়োগের ১ লাখ ২০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহন করেছেন।
এদিকে বিড়ইল উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির অবৈধভাবে সভপতি থাকার সুবাদে চার পদে কর্মচারী নিয়োগে ওই শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে ঘুষ নিয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।
রাজশাহী আঞ্চলিক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা কার্যালয়ের উপণ্ডপরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দীনের নিকট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আলমের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, এসব অভিযোগ কেউ আমাদের দপ্তরে দেয়নি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানান তারা।