টিস্যু ব্যাগ তৈরির কারখানায় গামছা মাথায় দিয়ে গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত এক যুবক দীর্ঘক্ষণ ধরে ঘামযুক্ত শরীরে ছাপা মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে সাদা টিস্যু ব্যাগের উপর ছাপানোর কাজ করছেন। কারখানার মধ্যে নারী পুরুষ মিলিয়ে আরো পাঁচজন কর্মীকেও কাজ করতে দেখা যায়। তাদের কাজও তিনি মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে দিচ্ছেন দেখভাল করছেন। এই ব্যক্তিটি অ্যাসিড দগ্ধ একজন সফল উদ্যোক্তা এবং কালীগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত ব্যাগ ব্যবসায়ি বিপুল হোসেন। তিনি ঝিনাইদহের সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের পোড়াব্যাতা গ্রামের ফজলুর রহমান মন্ডল ও ময়না বেগম দম্পতির ছেলে। গ্রামের মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছেলে বিপুল হোসেন এসএসসি পরীক্ষার পর আর মন বসাতে পারেননি লেখাপড়ায়। তাই ব্যবসা শেখার জন্য গ্রাম থেকে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলা বাজারের কাপুড়িয়া পট্টির মৃত শওকত হোসেনের কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ শুরু করেন। সেই সুবাদে দোকান মালিকের বাড়ি কালীগঞ্জ পৌর এলাকার হেলাই গ্রামে বিপুল হোসেন রাত্রি যাপন করতেন। এভাবে কেটে যায় প্রায় তিন বছর। হঠাৎ এক রাতে দোকান মালিকের বাড়িতে দুর্বৃত্তরা এসিডে ঝলসে দেয় বিপুল হোসেনের মাথা, মুখের বাম পাশ, বুক ও দুই হাতের বেশ কিছু অংশ। "এসিড সারভরাস ফাউন্ডেশন" নামের একটি বিদেশি মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রায় ৪ বছর চিকিৎসা সেবা গ্রহন শেষে শারীরিক ভাবে মোটামুটি সুস্থ হন বিপুল। সংস্থাটি বিপুলকে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ এবং একই সাথে নগদ ৩০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং অ্যাসিড দগ্ধ হওয়ায় সরকারি ভাবে আরো ৩০ হাজার টাকা অনুদান পাই বিপুল। সর্বমোট ৯০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন বিপুল। প্রবল আত্মবিশ্বাস ও মনোবল নিয়ে ২০০৬ সালে গান্না গ্রামের নিজ বাড়িতে কাগজের শপিং ব্যাগ তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। প্রাথমিক ভাবে নিজে ব্যাগ তৈরি ও বিক্রির কাজ করতেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই মার্কেটে ভালো সাড়া পাওয়ায় বিপুলের মনোবল আরো বেড়ে যায়। এ সময় ব্যবসা প্রসারিত করার লক্ষ্যে কালীগঞ্জ শহরের প্রথমে নদীপাড়া এবং পরবর্তীতে হেলাই গ্রামে বসবাস শুরু করে ওই এলাকার গৃহিণীদের দিয়ে ব্যাগ বানানো শুরু করেন। বাসা বাড়ির কাজ সেরে নারীরা কাগজের ব্যাগ তৈরি করে টাকা উপার্জন করা শুরু করেন। অনেক মহিলা প্রতিদিন ১ হাজার পিস ব্যাগ তৈরি কাজ করে মজুরি হিসেবে তিন শত করে টাকা পেতেন। বাজারে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাগ তৈরির কাজও বেড়ে যায় বহুগুণে। বিপুল বাজারের দোকান গুলো থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে দোকানের নাম দিয়ে প্রেস মেশিনে দিয়ে ছাপিয়ে ব্যাগ তৈরি করে তা বাজারজাত করা পর্যন্ত সব কাজ নিজেই তদারকি করতেন। ওই সময় একটি কাগজের শপিং ব্যাগ তৈরি করতে খরচ হতো ২ টাকা। আর বিক্রি হতো প্রতিটি ৩ টাকা। কাগজের তৈরি শপিং ব্যাগের ব্যবসায় ভালো মুনাফা পেতেন বিপুল। কালীগঞ্জ ও তার আশপাশের কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, জীবননগর, সীমাখালি, আড়পাড়া, খাজুরা ও বিভিন্ন ছোটো খাটো বাজার গুলোতে বিপুলের তৈরী ব্যাগের একচেটিয়া চাহিদা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনের অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেন তিনি। শহরের কৃষি অফিস পাড়ায় জমি কিনে দোতলা বাড়ি করেন। নিজের তৈরি বাড়ি নিচতলায় বর্তমানে তার ব্যাগ তৈরির কারখানা রয়েছে। ২০১৪ সালের পর থেকে কাগজের তৈরি শপিং ব্যাগের প্রচলন ধীরে ধীরে একেবারেই কমে যায়, পক্ষান্তরে টিস্যু কাপড়ের তৈরি ব্যাগের প্রচলন শুরু হয়। যে কারণে এখন ঢাকার প্যেরী, ম্যাটাডর ও আরএফএল কোম্পানির বিভিন্ন সাইজের টিস্যু ব্যাগ কিনে এনে নিজের কারখানায় ছাপিয়ে বাজারজাত করছেন তিনি। বর্তমানের টিস্যু ব্যাগ তৈরির ব্যবসায় বিপুলের ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার মতো পুঁজি খাটলেও পূর্বের মত লাভ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ের পর থেকে ব্যাগ তৈরির ব্যবসার এই দুরবস্থা বিরাজমান। তবুও থেমে যাননি বিপুল হোসেন। বর্তমানে তার ব্যাগ তৈরির কারখানায় সাতজন কর্মীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। সব খরচ খরচা বাদ দিয়ে অ্যাসিড দগ্ধ বিপুল হোসেন প্রতি মাসে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা আয় করছেন। এসিডে দগ্ধ হওয়ার পর মনোবল নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে একজন সফল ব্যবসায়ি হিসেবে তিনি আজ সমাজের অনুকরনীয় একজন। বিপুল হোসেনের ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করেন চাপালী গ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শাহিন হোসেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, ভাইয়ের ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করে আমার সংসার চলে। পরিবার-পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে ভালই যাচ্ছে দিন। একই কারখানায় কাজ করেন কাদিরকোল গ্রামের লক্ষীরানী। তিনি বলেন, বিপুল দাদার কারখানায় আমি কাজ করি। সারাদিন কাজ করে যা পায় তা দিয়ে আমার স্বামীর সংসারে অনেক সহযোগিতা হয়। কালীগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ি মনির গার্মেন্টস এর স্বত্বাধিকারী মনির হোসেন বলেন, আমার দোকানের যত শপিংব্যাগ আমি বিপুল ভায়ের কাছ থেকেই নিই। অ্যাসিড দগ্ধ একজন মানুষ এত পরিশ্রম করতে পারে তাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। বর্তমানে তিনি কালীগঞ্জসহ আশপাশের সব বাজারেই সুনামের সাথে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আমি তার সফলতা কামনা করছি। অ্যাসিড দগ্ধ বিপুল হোসেন নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, কালিগঞ্জ বাজারে এসেছিলাম কাপড়ের ব্যবসা শেখার জন্য, অথচ আজ আমি একজন ব্যাগ ব্যাবসায়ী। এসিডে নিজের শরীর দগ্ধ হওয়ার পর জীবনের মোড় ঘুরে গেছে আমার। প্রবল ইচ্ছে শক্তি ও মনোবল আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি চেষ্টা করেছি আর তার উত্তম প্রতিদান ও আল্লাহর ইচ্ছায় আমি পেয়েছি। কালীগঞ্জ পৌর ব্যবসায়ি সমিতির সভাপতি আসাদুজ্জামান বলেন, ব্যাগ ব্যবসায়ি অ্যাসিড দগ্ধ বিপুলকে দেখে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। সে চেষ্টা করেছে বলেই আজ সফল হয়েছে। অত্যন্ত পরিশ্রমি এই ব্যবসায়ির জন্য শুভকামনা রইল।