বাংলা মাস কার্তিক। অগ্রহায়ণের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি। শিশিরের মতো নীরবে আবির্ভাব। ষড়ঋতুর দেশে নবান্নের সুবার্তা নিয়ে আসে কার্তিক। ফসলের ক্ষেতে সোনালি হাসির আভা ছড়িয়ে পড়ে। কার্তিকের শুরুতেই থাকে মোলায়েম কুয়াশায় ছাতিম আর শিউলির মৃদুমন্দ সৌরভ, হিমেল ছোঁয়া। সকাল-সন্ধ্যায় হেমন্তের মিহি কুয়াশা। 'আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান/সারামাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান/ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়/কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।' নক্সী-কাঁথার মাঠে কবি জসীমউদ্দীন এভাবেই কার্তিকের রূপলাবণ্য বর্ণনা করেছেন।
উপজেলার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠজুড়ে সোনালি ধান। কেউ কাটছেন, কেউ আঁটি বাঁধছেন। অন্যরা ভাড় বা মাথায় করে ধান নিয়ে যাচ্ছেন বাড়ির উঠোনে। দম ফেলার ফুরসত নেই কারও। মহাব্যস্ততায় দিন কাটছে কৃষকের। বেশ কিছু এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ধান কাটা শেষ হবে বলে জানান কৃষকেরা। মৌসুম শুরুর আগেই ধান কাটা হলে সেই জমিতে রবিশস্য বিশেষ করে আলু ও সরিষা চাষ করা যায়। একারণেই তারা এবার বিনা-৭ ও ধান-৯০ জাতের ধান লাগিয়েছিল। চাষ মৌসুমের শুরু থেকেই বৃষ্টি হওয়ায় আমন ধানের ফলন ভাল হয়েছে। কৃষকরা জানান, প্রতি বিঘা জমিতে বিনা-৭ বিঘায় ১২ থেকে ১৪ মণ এবং ব্র্রি ধান-৯০ বিঘায় ১৪ থেকে ১৬মণ করে পাওয়া যাচ্ছে। জমি থেকে কাটার পর মাড়াই করেই বাজারে তলে কাঁচা ধানের দাম পাওয়া যাচ্ছে বিনা-৭ ধান ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা মণ।
উপজেলায় নবান্নের আমেজ শুরু হয়েছে বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায়। জমিতে লাগানো আগাম জাতের আমন ধান কেটে ঘরে তোলা শুরু করেছেন উপজেলার কৃষকরা। চিরায়ত নিয়মে হেমন্তের মধ্যভাগে (১-অগ্রহায়ণ) নতুন ধান ঘরে তোলার পর বাঙালির নবান্ন উৎসব শুরু হয়। বাংলার কৃষক সমাজ প্রাচীনকাল থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে আসছে। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও কৃষকরা নবান্ন উৎসব পালন করতে ভুলে যায়নি আজও। গ্রাম বাংলায় কৃষকেরা নবান্ন উৎসব পরিপূর্ণ ভাবে উদযাপনের জন্য মেয়ে জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে আমন্ত্রণ করে এনে নতুন চালের পোলাও, পিঠা ও পায়েসসহ রকমারী নিত্য নতুন খাবার তৈরী করে ধুম-ধামে ভুঁড়ি ভোজের আয়োজন চলছে।
এবিষয়ে উপজেলার কাথম গ্রামের কৃষক মহাতাব সরদার বলেন, গ্রাম্যবধুরা জামাইকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ীতে নবান্ন উৎসব করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। নবান্ন উৎসবে গ্রামের কৃষকেরা মিলে-মিশে গরু, মহিষ ও খাঁসি জবাই করে। হাট-বাজারের বড় মাছ কিনে আনে। এই নিয়মের ধারাবাহিকতায় কৃষকদের ঘরে ঘরে চলছে এখন ঐতিহ্যবাহী নবান্ন আমেজ। সব-মিলিয়ে নন্দীগ্রাম উপজেলার কৃষকেরা নবান্ন উৎসব পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে চলছে ঐতিহ্যবাহী বাৎসরিক নবান্ন উৎসব পালনের প্রস্তুতি।
উপজেলার বিজয়ঘাট গ্রামের কৃষক মহব্বত আলী বলেন, হরতাল ও অবরোধের কারণে এবার ধানের দাম কম। খরচ উঠায় কঠিন হয়ে পড়বে। তারপরও 'ফলন ও দাম যা-ই হোক জমিটা আগেই খালি হওয়ায় এখন সরিষা চাষ করা হবে। নমলা (বিলম্বে চাষ) ধান লাগালে অন্য ফসল আর লাগানো হতো না।'
এপ্রসঙ্গে নন্দীগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার মো. গাজিউল হক বলেন, এই উপজেলার কৃষকরা ১৯হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধান রোপন করেছে। ‘ইতিমধ্যে পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। মাঠপর্যায়ে খেতের অবস্থা ও চাষিদের সঙ্গে সমন্বয়ে করে জেনেছি আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে আমন চাষে প্রত্যেক চাষি লাভবান হবেন।’