ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে লাল ফিতার বাধা দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, সবার সহযোগিতায় আমাদের রপ্তানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এ সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন-পূর্ব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম-নীতির বেড়াজালে উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন আটকে যায়। এ বাধা দূর করতে হবে, আইন ও নীতিমালা বদলাতে হবে। আইন ও নীতিমালা করা হয়েছে কাজের জন্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির পথে অহেতুক কালক্ষেপণ বড় বাধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি কাজের জন্য মন্ত্রণালয়ে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়, অথচ এগুলো দেখার জন্য সরকার লোক নিয়োগ করে রেখেছে। মন খুলে এগুলো দেখলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, একটি স্বাধীন সমৃদ্ধ জাতির জন্য মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখেছেন, যুদ্ধে আপনজনকে হারিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু জীবনের বড় একটি সময় জেলে কাটিয়েছেন। আমরা যদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারি, তাহলে আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। বাংলাদেশের গ্যাস বিক্রিতে মার্কিন একটি কোম্পানিকে লাভবান না হতে দেওয়ায় ২০০১ সালে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। সেই শক্তি আবার উঠে-পড়ে লেগেছে, যোগ করেন মন্ত্রী। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে সহায়তা করা। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের মাধ্যমে যেন ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। সিনিয়র কর্মকর্তাদের কার্যকর ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। কৃষক, শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা সম্পদ সৃষ্টি করছেন। সম্পদ বাড়ানো ও সুসংহত করতে সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়কের ভূমিকা পালন করতে হবে। কেউ সহায়তা নিতে এসে যেন ফেরত না যান, বলেন তিনি। এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয়ে সমস্যা হয়। এসব সমস্যা দূর করতে উদ্যোগ নিতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ভবন হবে ১৫তলা বিশিষ্ট। এতে তিনটি বেজমেন্ট থাকবে। বাকি ১২তলায় অফিস স্পেস। ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে ২৮৪ কোটি টাকা। ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে। ইপিবির চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন প্রকল্প পরিচালকসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠান শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী রপ্তানি উন্নয়ন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন দপ্তর ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে দেশব্যাপী এক কোটি স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ড বিতরণ ও চালসহ টিসিবি পণ্য বিক্রয় কার্যক্রম-২০২৩ এর উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত পিডব্লিউডি স্টাফ কোয়ার্টারে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) আঞ্চলিক কার্যালয়। এসময়বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আলু কোল্ড স্টোরেজে আছে। এটা ঠিক ব্যবসায়ীরা কিছুটা সুযোগ নিচ্ছেন। এখানে কিছু তথ্য সংক্রান্ত ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এক কোটি ৭-৮ লাখ মেট্রিক টন আলু আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়। আর আমরা ভোগ করি ৭০-৭৫ লাখ মেট্রিক টন। তাহলে ২৭ লাখ মেট্রিক টন আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু আমরা এই হিসাবটি সঠিক বলে দেখছি না। আজকে আমরা সব কোল্ড স্টোরেজ হিসাব করে দেখেছি, এক কেজি আলুও আমদানি হয়নি। তাহলে কোথাও ভুল রয়েছে। হয় উৎপাদনের পরিসংখ্যানে ভুল আছে, অথবা চাহিদাতে ভুল আছে। এই ভুলের কারণে সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা আজকে কোল্ড স্টোরেজে পণ্য রেখেছেন। সেই পণ্যের ওপর দাম বাড়িয়ে দিয়ে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছেন। আমরা সেটি নিরসন করার চেষ্টা করছি এবং পাশাপাশি আলু আমদানির ব্যবস্থা করেছি। তিনি বলেন, আজকে দেশে আলু আসতে শুরু করেছে। ৬৮ হাজার টন আলু দেশে এসেছে। যা আমাদের জন্য কিছুই না। কিন্তু তারই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন আলু ঢুকবে, তারা দাম কমাতে শুরু করেছেন। এই কথা সত্যি অসাধু ব্যবসায়ীরা বারবার সুযোগ নেয়। আমরা চেষ্টা করছি, সীমিত জনশক্তি নিয়ে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার। পেঁয়াজের দামের বিষয়ে টিপু মুনশি বলেন, আমরা এক দুঃসময় পার করছি। আজকে বিশ্বজুড়ে যে মূল্যস্ফীতি চলছে, এর প্রভাব থেকে আমরা বের হতে পারছি না। আমাদের দেশে যতটুকু পেঁয়াজ প্রয়োজন তার ৮০ শতাংশ আমরা উৎপাদন করি। ২০ শতাংশ পেঁয়াজ আমাদের সংকট রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা এটি উন্নীত করার চেষ্টা করছি। এই বছরও আমাদের ২৪ লাখ টন পেঁয়াজ প্রয়োজন। এর মধ্যে আমাদের ৭-৮ লাখ টন সংকট রয়েছে। এটি আমাদের আমদানি করতে হয়। আর আমরা ৯০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করি ভারত থেকে। কিন্তু গত কয়েক মাস আগে ভারত তাদের পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলো। তাদের দেশেও অভাব শুরু হয়েছে। তিনি আর বলেন, গত দিন ১৫ আগে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির দাম ঠিক করে দিয়েছে আটশ ডলার। অতএব ভারত থেকে যদি পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, তাহলে আমাদের ৯০ টাকা কেজি দাম ধরতে হবে। তারপর আবার ট্যাক্স আছে, ডিউটি আছে। অর্থাৎ ভারত থেকে আমরা যদি পেঁয়াজ আমদানি করি তাহলে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দাম পড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের এই দামেই পেঁয়াজ আনতে হবে। আমাদের দেশি পেঁয়াজও শেষ প্রান্তে। আশা করছি, আগামী মাসের মাঝামাঝিতে নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে, তখন পেঁয়াজের দাম কমবে। ডিমের দামের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডিম আমাদের দেশে একটিও ঢুকেনি। কিন্তু ডিম আমদানির নির্দেশ দেওয়ার পরদিন এক টাকা করে প্রতি ডিমে দাম কমে গেছে। দেড় মাস চেষ্টার পর আমরা ডিম আমদানি করতে পারলাম। বিভিন্ন আইনি জটিলতা পার করে গত দুই দিন আগে ডিম দেশে এসেছে। বাজারে ভীষণ রকমভাবে এর প্রভাব পড়েছে। আজকে কোথাও কোথাও ১০ ও সাড়ে ১০টাকায় কোথাও কোথাও ডিম পাওয়া যাচ্ছে। আলুও আসতে শুরু করেছে। আলুর দামও কমবে। তিনি আরও বলেন, আমরা একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরি করতে চেয়েছিলাম। অসংখ্য মানুষের রক্তে কেনা এই বাংলাদেশ। আমাদের এই বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ করতেই হবে। কোনো অসাধু রাজনীতিবিদ, সুযোগ সন্ধানী, যাদের মাথার ওপর এখনো পাকিস্তানের ভূত আছে, সেসব রাজনীতিবিদের হাত থেকে বাংলাদেশকে আমাদের বের করে নিয়ে আসতে হবে। টিসিবির স্মার্টকার্ডের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এক কোটি পরিবারকে টিসিবির স্মার্টকার্ড দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। এখন থেকে আর কোথাও কোনো অসামঞ্জস্যতা থাকবে না। আমরা কয়েক মাসের মধ্যে এই এক কোটি কার্ড সবার মাঝে পৌঁছে দেবো। এর জন্য কোনো টাকা দিতে হবে না। কেউ একটি টাকাও এর জন্য খরচ করবেন না। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। এ ছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান, ডিএসসিসির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মামুন রশিদ শুভ্র। এতে সহযোগিতা করেন মেসার্স জে. কে. ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. মনির হোসেন জমাদ্দার। এই স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে একটি পরিবারকে ৩০ টাকা দরে পাঁচ কেজি চাল, ১শ টাকা দরে দুই লিটার সয়াবিন তেল, ৬০ টাকা দরে দুই কেজি মসুর ডাল, ৭০ টাকা দরে এক কেজি চিনি দেওয়া হবে।