টেকসই বেরিবাঁধ হস্তান্তরের আগেই ভাঙ্গন দেখা দেওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে শরণখোলাবাসীর মাঝে। ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেরিবাঁধের একাধিক স্থানে ফাটল ধরেছে। প্রায় ৭‘শ মিটার বাঁধের ব্লক ধ্বসে বিলীন হচ্ছে বলেশ্বর নদীতে। ঝুকির মধ্যে রয়েছে অন্তত ২০ কিলোমিটার বেরিবাঁধ। হস্তান্তরের আগেই এমন অবস্থা হওয়ায় চিন্তিত এলাকাবাসী। নদী শাসন প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় বাগেরহাটসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলা। সরকারি হিসেবে এই দিনে প্রায় ৯‘শ ৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সিডরের আঘাতে। আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল কয়েকশ কোটি টাকার। স্বজন হারানো বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে শরণখোলা-মোরেলগঞ্জবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেরিবাঁধ। গণ মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৫ সালে ২৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মান শুরু হয়। বেরিবাঁধের ৯৫ শতাংশ কাজ শুরু হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে বাঁধ হস্তান্তরের আগেই শরণখোলা উপজেলার বগী, গাবতলা, মোরেলগঞ্জের আমতলা এলাকা থেকে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। বাঁধের ব্লক ধ্বসে বিলীন হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও বেশকয়েকটি স্থান ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। হস্তান্তরের আগেই এমন অবস্থা হওয়ায় চিন্তিত এলাকাবাসী। শরণখোলা উপজেলার দক্ষিন সাউথখালী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বারেক বলেন, বলেশ্বর নদীর ভাঙ্গনে আমার ও পরিবারের প্রায় ১৫০ বিঘা জমি হারিয়েছি। সিডরে স্বজন হারিয়েছি। বাঁধ নির্মান শুরু হলে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। ভাঙ্গন ও দূর্যোগ থেকে মুক্তি পাব। সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রুপ নিয়েছে। টেকসই বেরিবাঁধেই ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। যেকোন মুহুর্তে বড় ধরণের ভাঙ্গন শুরু হবে। এখন মনে হচ্ছে বিপুল টাকার এই বাঁধ আমাদের কোন কাজে আসবে না। গাবতলা এলকার আঃ রহিম দুলাল বলেন, বাঁধ নির্মানের শুরুতেই আমরা নদী শাসনের দাবি করেছিলাম। এজন্য সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছিলাম। তারপরও নদী শাসন না করে বাঁধ নির্মান করেছে সিইআইপি প্রকল্প। এখন বাঁধে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে, ফসলি জমি, গাছপালা, বসত ঘর ঝুকির মধ্যে রয়েছে। ফসিয়াতলা এলাকার গফার তালুকদার বলেন, প্রতিনিয়তই ভাঙ্গনে ধ্বসে পড়ছে টেকসই বাঁধের ব্লকগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন জিওব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন বন্ধের চেষ্টা করলেও, কোন কাজে আসছে না। নদীতে পানির গভীরতা ৫০ থেকে ৬০ হাতের উপরে। সরকারের কোটি কোটি টাকা জলেই যাচ্ছে। এদিকে ভাঙ্গনরোধে জরুরী ভিত্তিতে জিওব্যাগ ফেলে কোন কাজে আসছেনা বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারের প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, গেল ১৫ দিনে গাবতলায় ভাঙ্গনরোধে ২০০ মিটার জায়গায় ১৪ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তারপরেও ভাঙ্গন রোধ হচ্ছে না। এখানে কংক্রিটের ব্লক ফেলানো জরুরী বলে জানান তিনি। শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, সিডরের পরে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টেকসই বেরিবাঁধ নির্মানের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সিআইপি প্রকল্পের দূরদর্শিতার অভাবে নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মানের ফলে আজ বাঁধটি হুমকির মধ্যে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন ও ফাটল দেখা দিয়েছে। আমাদের আবারও দাবি খুব শীঘ্রই নদী শাসন করে বাঁধটি টেকসই করতে হবে। সিইআইপি প্রকল্পের মাঠ প্রকৌশলী মোঃ রাকিবুল ইসলাম নাহিদ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিলোমিটার বেরিবাঁধ নির্মানের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে কাজ হস্তান্ত করা হবে। তবে বলেশ্বর নদীর স্রোত তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। আমরা মাঠে থেকে পর্যবেক্ষন করে কাজ করছি। তবে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নদী শাসন জরুরী হয়ে পড়েছে বলে জানান এই প্রকৌশলী। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ বলেন, ৬২ কিলোমিটার বেরিবাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুকিপূর্ণ। নদীর গভীরতা ও স্রোত বেশি থাকায় ভাঙ্গন সৃষ্টি হওয়ায় নদী শাসনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব উর্দ্ধোন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে ভাঙ্গনের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। উল্লেখ্যে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাতে উপকুলীয় শরণখোলার ৩৫/১ পোল্ডারের প্রায় ২০ কিঃমিঃ বেড়ীবাধ লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। ২২০ কিঃমিঃ বেগের ঘূর্ণীঝড় আর ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যায় বিশ গ্রামের মানুষের ঘর-বাড়ি,গাছপালা ,রাস্তাঘাট। বলেশ্বর নদ তীরবর্তী বগী, দক্ষিন সাউথখালী,উত্তর সাউথখালী সহ ৫ টি গ্রামের প্রায় ১২শ মানুষের নির্মম মৃত্যূ হয়।এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলো শিশু ও নারী। গবাদি পশু মারা যায় দশ সহা¯্রাধিক। মাছের ঘের সহ আমনের ক্ষেত যায় ভেসে। বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাড়াতে সেদিন সরকারী,বে-সরকারী সংস্থা সহ বিদেশীরাও বিভিন্ন সাহায্য নিয়ে ছুটে আসেন। সর্বহারা মানুষ ধ্বংস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেদিন দাবী জানায় ত্রান চাইনা টেকসই বেড়ীবাধ চাই। ভুক্তভুগীদের দাবীর সাথে একাত্বতা জানিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থীক সহায়তায় বাগেরহাটের শরণখোলা-মোরেলগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের ৬২ কিঃমিঃ জায়গা জুড়ে টেকসই বেড়ীবাধ নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। জানাযায়, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ্যায়নে পরিচালিত উপকুলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) অধীনে বেড়ীবাধের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারী। কাজ বাস্তবায়নের দায়ীত্ব পান সিএইচডব্লিউ নামের চীনের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে সালের জানুয়ারী মাসে নির্মান কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বর্ধিত সময়ানুযায়ী কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। ৬২ কিঃমিঃ বাঁধের শরণখোলার সুন্দরবন সংলগ্ন বগী গ্রাম থেকে মোরেলগঞ্জের ফাসিয়াতলা পর্যন্ত মোট ২০ কিলোমিটার নদী তীর এলাকা ভাঙ্গন কবলিত।