আগে প্রাত্যহিক নানা কাজে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। মৃৎশিল্প কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিল্প। অথচ এই শিল্প আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। একসময় বহু পরিবার এই পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও দিনদিন কমে যাচ্ছে সংখ্যা। আর যারা কাজ করছেন তারাও নানা প্রতিকূলতার মাঝে কোনোরকমে টিকে আছেন। তাদের দাবি, সরকারিভাবে এই শিল্পে সহযোগিতা ও আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে পারলে আবার ফিরবে এর হারানো জৌলুস। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে নিকলীতে কুমার সম্প্রদায়ের প্রায় ৬৫ পরিবারের ২০৫ নারী-পুরুষ মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে কোনোমতে টিকে আছেন। এরমধ্যে নিকলী সদর ইউনিয়নেই সবগুলো পরিবার আছে। সদর ইউনিয়নের পাল পাড়া, মোহরকোনা ভাটিপাড়ায় কুমাররা আছেন। উপজেলার মৃৎশিল্পীরা মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরির পাশাপাশি সব ধরনের দেবদেবীর প্রতিমা তৈরিতে দক্ষ। এ ছাড়া হাড়ি, কলস, মটকা, বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক, ফুলদানি, সানকি, বদনা, দইয়ের ভাঁড়, ঘটি, মালসা, পাতিল, ছাইদানি ইত্যাদি তৈরি করে থাকেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিকলী উপজেলা মৃৎশিল্পের জন্য একসময় বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে সিলভার, স্টিল, প্লাস্টিক, সিরামিক, চীনামাটির অত্যাধুনিক তৈজসপত্রের কারণে মৃৎশিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এছাড়া, মাটির দাম বেশি, জ¦ালানির দাম বেশি, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব, মাটির তৈরি জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য আলাদা ঘরের অভাবসহ নানা কারণে মৃৎশিল্পদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে। ফলে অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। আর যারা বাপ-দাদার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত তারা ঠিকমতো সংসার চালাতেই পারছেন না। তবে কুমারদের দাবি, বর্তমান চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে মাটির সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করতে পারলে তাদের সচ্ছলতা আসবে। আর এই সৌখিন জিনিসপত্র তৈরির জন্য তাদের বিভিন্ন উপকরণসহ প্রশিক্ষণ দরকার। মাদারীপুরে তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দিনদিন হারাতে বসেছে এই পেশা। আর নানা প্রতিকূলতার মাঝেও যারা এই পেশায় আছেন, তারা মূলত পৈত্রিক এ পেশার প্রতি সম্মান দেখিয়ে মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। নিকলীর কুমারপাড়ার কুমাররা জানান, বর্তমানে বেশিরভাগ কুমারের পুনের ঘর (যে ঘরে চুলার মধ্যে মাটির তৈরি জিনিসপত্র পোড়ানো হয়) নেই। তাই তাদের জিনিসপত্র পোড়াতে সমস্যা হয়। তাছাড়া যাদের পুনের ঘর আছে, তাও জরাজীর্ণ। বর্ষার সময় বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। এ ছাড়া মাটির দাম বেশি, জ¦ালানির দাম বেশি হওয়ায় তারা জিনিসপত্র বানাতে পারছেন না। তাছাড়া তারা সেই পুরোনো জিনিসপত্রই বানান। কিন্তু আধুনিক জিনিসপত্র বানানোর বিষয়ে সরকারিভাবে যদি তাদের সহযোগিতা বা প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা হলে এই শিল্পের দুর্দিন যেত। কুমারপাড়ার দুলাল পাল বলেন, এ পেশায় থেকে জীবন আর চলে না। আগের মতো মানুষজনের কাছে মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা নেই। যা আয় হয় তা দিয়ে ঠিকমতো খেতেই পারি না। তাই ভাবছি অটোরিকশা চালাবো। তাতে করে আমাদের সংসার চলবে। কষ্ট কম হবে। কিছুটা হলেও অভাব দূর হবে। একই এলাকার হরিদাস পাল বলেন, অনেকদিন ধরে ভাবছি এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাবো। কিন্তু বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে মন চায় না। অনেক কষ্ট করে এখন পর্যন্ত টিকে আছি। কতদিন পারবো জানি না। একই এলাকার কাজল পাল বলেন, আমার দাদা ধীরু পাল বাবা গৌরাঙ্গ পাল এ কাজ করছেন। কিন্তু বর্তমানে প্লাস্টিকের জিনিসপত্রের ভিড়ে আমাদের এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এ পেশায় থেকে পেটের খাবারটুকুই যোগাড় করা কষ্টকর। তাই বাধ্য হয়ে এ পেশা ছেড়ে ব্যবসা করার চিন্তা করছি। নিকলী উপজেলা পূঁজা উদযাপন কমিটির সভাপতি বিপুল দেবনাথ, সহসভাপতি দিলীপ কুমার সাহা, সাধারণ সম্পাদক কার্তিক সুত্রধর বলেন, হাত এবং চাকার সাহায্যে কাদা মাটি দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরির পর কাঁচা থাকতে তাতে কাঠি দিয়ে পাতা, ফুল, পাখি ও রেখাদির নকশা করা হয়। কখনো আবার দ্রব্যাদি পোড়ানোর পর এতে নানা রঙের সমাবেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ আকর্ষণীয় নকশা করা হয়। খেলার পুতুল ও ঘর সাজানোর সৌখিন দ্রব্যও কুমাররা তৈরি করেন। তারা হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণ করেন। বাঁশ, খড়কুটা, মাটি, কাপড় ও রং দিয়ে নির্মিত তাদের এ মূর্তিগুলো এক অসাধারণ শিল্পকর্ম। বাড়ির মেয়েরা মৃৎশিল্পের নানা দ্রব্য তৈরিতে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করেন। এতে রয়েছে তাদের সুনিপুণ দক্ষতা এবং কুশলতা। তবে বর্তমানে এ শিল্পের দুর্দিন চলছে। একে বাঁচাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। তা না হলে একসময় এর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ শাকিলা পারভিন জানান, মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উপজেলা পর্যায় থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও আর্থিক সহযোগীতা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো উদ্যোগ নেওয়া হবে, এতে করে কুমাররা উপকৃত হবে।