দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। সে অনুযায়ী সরকার দলীয় আওয়ামীলীগসহ নির্বাচনমূখী রাজনৈতিক দলগুলি একে একে দলীয় মনোয়ন বিক্রির পর ইতোমধ্যে তাদের চুড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ গত ২৬ নভেম্বর ২৯৮ আসনে তাদের চুড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। এবার সারাদেশে ৭১টি আসনে বাদ পড়েছেন গতবারের দলীয় মনোনীত এমপিরা। বাদ পড়াদের স্থলাভিষিক্ত করতে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী নতুনদের তালিকায় একে একে দেখিয়েছেন চমক। তবে খুলনা-৬, সংসদীয় ১০৪ আসনে ছিল বিষ্ময়কর চমক। সমস্বরে উচ্চারিত হেভিওয়েটদের ভীঁড়ে একেবারেই অনুচ্চারিত ও মনোনীত প্রার্থী নিজেই অন্যের জন্য ভোট ও দোয়া প্রার্থনা করা মো. রশীদুজ্জামান মোড়লকে মনোনয়ন দিয়ে রীতিমত বিষ্ময়কর চমক সৃষ্টি করেছে দলটি। যদিও মনোনয়ন ঘোষণার আগে বর্তমান এমপি আক্তারুজ্জামান বাবুর বাদ পড়া ও নতুন মুখ আসার বিষয়টি দলীয় নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তৃণমূলে গুঞ্জণ ছিল। তবে মো. রশীদুজ্জানের মনোনয়নের বিষয়টি কারো মধ্যে কোন রকম আলোচনায় ছিলনা। এমনকি মনোনয়ন তালিকায় রশীদুজ্জামানের নাম ঘোষণার পর নাম বিভ্রাট নিয়েও তাৎক্ষণিক শুরু হয় অন্য রকম প্রচার-প্রচারনা। তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে আসা মো. রশীদুজ্জামান আ.লীগ দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা উচ্ছ্বসিত। যদিও আ.লীগের মনোনয়ন বঞ্চিতদের একাধিক প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। রাজনৈতিক তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সদস্য সচিব মো. রশীদুজ্জামান মোড়ল একসময় বাম রাজনৈতিক সংগঠন সিপিবির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরপর আ.লীগে যোগদান করে অল্প দিনেই নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। এরপর দলীয় মনোনয়নে ২০০৯ সালে পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জামানত হারান। সে সময় দল থেকে সাময়ীক বহিষ্কার হলে বহুলাংশে কোনঠাঁসা হয়ে পড়েন তিনি। তবে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও দলীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি রাজনীতিতে মাঠে টিকে ছিলেন তিনি। তৃণমূলে আ.লীগের রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা ও দলীয় মনোনয়ন পেতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি তার। এমনকি রাজনৈতিক মাঠে নিজের অবস্থান জানান দিতে স্ব-ঘরানায় অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীর পক্ষেও মাঠ মাতিয়েছেন রাজনৈতিক এ ত্যাগী নেতা। হয়তোবা এসব বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সর্বশেষ দল থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জানাগেছে, ছাত্র জীবন থেকে গণ মানুষের অধিকার আদায়ে স্বোচ্চার এই নেতা মূলত আশির দশক থেকে নিজ জনপদে অপরিকল্পিত ও পরিবেশ বিধ্বংসী চিংড়ি চাষ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। বাম রাজনীতির ছায়াতলে এসব আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেকে সপে তিনি বারংবার পুলিশী হয়রাণি ও প্রভাবশালী মহলের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জেলও খেটেছেন কয়েকবার। এলাকাবাসীর ভালবাসার টানে স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি কপিলমুনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯০ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েও শেষ পর্যন্ত পরাজিত দেখানো হয় তাকে। সাবেক ছাত্র নেতা মো. রশীদুজ্জামান ১৯৮১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পরই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রঐক্য পরিষদের ব্যানারে সামনে থেকে নের্তৃত্ব দেন। তৎকালীন স্বৈরশাষক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালে সামরিক জান্তার হাতে গ্রেপ্তার হয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকারের পাশাপাশি কারাবরণ করেন। সে সময় আদালতে তার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার প্রবেশ পত্র দেখিয়ে জামিন পান। এমএ পরীক্ষার পূর্বে আবারো তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮৭ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সঙ্গে আরো তিনটি মামলা যোগ করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেবার দীর্ঘ মেয়াদে জেল খাটেন তিনি। এরপর বাম রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপর উপজেলা আ.লীগের সদস্য সচীব ও পরে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে আ.লীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন পরিচালনা করায় সারাদেশে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পর তার গোটা পরিবার চারদলীয় জোট সরকারের অবর্ণনীয় নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ডজন খানেক মামলায় মোকাবেলা করতে হয় তাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখা-পড়া, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি নিজ এলাকায় কৃষকদের জমি লবণ পানি মুক্ত রাখতে ঘের মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে মাটি ও মানুষের নেতা হিসেবে সমধিক পরিচিতি পান রশীদুজ্জামান। আশির দশকে খুলনা জেলার যে সকল এলাকায় চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছিল, সেই সকল ব্যাপক এলাকার মানুষদের সংগঠিত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। এজন্য তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন সহ বহু মামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে। দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। কিন্তু সেই আন্দোলন সফল হয়েছে। অবহিত সেই জনপদ এখন সবুজের সমারোহ। ধান, তরমুজ ও সবজি চাষ করে এলাকার মানুষ আজ সাবলম্বী। অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে এলাকায় ফিরে রাজনীতিতে সময় দেওয়ার জন্য চাকরির প্রত্যাশা করেননি সাহসী তরুণ নেতা রশীদুজ্জামান। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অব্যাহত চমক সৃষ্টিকারী আসনে তার কাঙ্খিত মনোনয়ন প্রাপ্তিতে সঙ্গত কারণেই তিনি ও তার অনুসারীরা উচ্ছ্বসিত। প্রসঙ্গত, গত ৩টি নবম, দশম ও একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থী ক্ষমতায় আসীন থাকা অবস্থায় প্রতিবার প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিবার নতুন প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সোহরাব আলী সানা নির্বাচিত হলেও পরের দশম নির্বাচনে তাকে পরিবর্তন করে প্রয়াত অ্যাড. শেখ মো: নূরুল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং তিনি নির্বাচিত হন। এরপর গত একাদশ নির্বাচনে সেই নূরুল হককে বাদ দিয়ে শেষ মূহুর্তে হেভিওয়েটদের ভীঁড়ে মনোয়ন দেওয়া হয় মো. আক্তারুজ্জামান বাবুকে। যার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও চতুর্থবারের মত প্রার্থী পরিবর্তন করে আক্তারুজ্জামান বাবুকে বাদ দিয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রশীদুজ্জামানকে দলীয় মনোনয় দেওয়া হয়েছে। এবার নির্বাচনে আসনটি থেকে মোট ১৮ জন মনোনয়ন প্রত্যাশী দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। সর্বশেষ গত রোববার সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতা ও পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. রশীদুজ্জামান মোড়লকে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করা হয়। এদিকে রাজনৈতিক প্রচারবিমুখ ও পোড় খাওয়া তৃণমূলের কর্মীবান্ধব এ নেতাকে মনোনয়ন দেওয়ায় এবং একই দলের মনোনয়ন বঞ্চিত একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ায় আসন্ন নির্বাচনে তার বিজয়ে প্রথমত চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হলেও ক্রমান্বয়ে অধিকাংশদের তিনি এক কাতারে আনতে সমর্থ হচ্ছেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক জীবনে একটা বড় সময় এলাকায় থিতু হয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে সময় নিজের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি খুঁজে খুঁজে সম্ভাবনাময় যুবকদের দলে সম্পৃক্ত করে দলকে সংগঠিত ও সমৃদ্ধ করায় তার সুফল পাচ্ছেন তিনি। যে কারণে জামায়াত অধ্যুষিত এক সময়ের ্এ জনপদের বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকান্ড, বিরোধীদের রাজনৈতিক দুর্বলতা, নতুন প্রজন্মের আওয়ামী সম্পৃক্তকরণসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থান অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে শক্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন পেয়ে অনুভূতি জানাতে গিয়ে মো. রশীদুজ্জামান বলেন, “আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা টানা তিনবারের সফল রাষ্ট্র নায়ক দলীয় সভাপতি দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। কারণ তিনিই আমাকে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন এবং আমি নির্বাচিত হয়ে যথাযথভাবে জনগণের সেবা করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমি আশা করছি, আমার নির্বাচনী এলাকার আপামর জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাকে সংসদে কথা বলার সুযোগ করে দিবেন। কারণ নৌকা আমার ব্যক্তিগত প্রতীক নয়, এটা জাতির জনকের প্রতীক, এটা স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রতীক, এটা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতীক। নৌকা মানেই হলো সরাসরি শেখ হাসিনাকে ভোট দেয়া। তাই আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে একটা কথাই বলব, দেশ ডিজিটাল থেকে এখন স্মার্ট বাংলাদেশের দোরগোড়ায়। তাই নৌকায় ভোট দিয়ে আমাকে জাতীয় সংসদে যাওয়ার সুযোগ করে দিলে স্মার্ট বাংলাদেশের অংশ হিসেবে আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ যেন সর্বপ্রথম স্মার্ট বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা পায়, অবহেলিত জনপদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দলকে সুসংগঠিত করার চেষ্টা করব। নির্বাচন নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আ.লীগ ও সহযোগি অঙ্গ সংগঠনের সকল নেতৃবৃৃন্দের প্রতি একটাই অনুরোধ থাকবে, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শেখ হাসিনার নৌকাকে বিজয়ী করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় সার্বিক সহযোগিতা করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, জাতির জনকের আদর্শকে যারা ধারণ ও লালন করেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে যারা শ্রদ্ধার সাথে মানেন, তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর নৌকা, শেখ হাসিনার নৌকাকে বিজয়ী করতে অবশ্যই সর্বদা ভোটের মাঠে থাকবেন। মনে রাখবেন, নৌকাকে জয়ী করে, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েই আমরা ঘরে ফিরব। তবে সর্বশেষ আসন্ন নির্বাচনে স্ব-ঘরানার প্রার্থীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিবার্চনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিরোধী দলের ভোটারদের অবস্থান, জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মোড়ল রশীদুজ্জামানের হাতে নৌকা কিভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের কাছে নৌকার কাছে পাত্তাই পাবেনা কোন প্রতীক। তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৭ জানুয়ারী পর্যন্ত।