প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য সাতক্ষীরা রেঞ্জ পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন কলাগাছিয়া টহল ফাঁড়ি ও ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র এখন পর্যটকের পদচারণায় মুখর। ইট-পাথরের নগর জীবনের ক্লান্তি দূর করে মানসিক প্রশান্তির জন্য এই সাগরপাড়ে প্রকৃতির সবুজ দেয়াল আর পাখ-পাখালির করলবে মুখরিত সুন্দনবনে দলবেঁধে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন পর্যটকরা। ‘সাতক্ষীরার আকর্ষণ, সড়ক পথে সুন্দরবন’-এ স্লোগান এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) কলাগাছিয়া টহল ফাঁড়ি ও ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে গিয়ে দেখা মিলেছে এমনই নান্দনিক সৌন্দর্যের। সড়ক পথে সাতক্ষীরার মুন্সীগঞ্জ হয়ে বুড়িগোয়ালিনী খেয়াঘাট থেকে কলাগাছিয়া ইকো-ট্যুরিজমে গেলে একঝাঁক বানর ছুটে এসে স্বাগত জানায় পর্যটকদের। এরপর দেখা যায়, কিছু হরিণ আশপাশেই ঘুরাঘুরি করছে। এ ছাড়া আছে শ্বাসমূলে ভরা গেওয়া, গরান, বাইন, পশুর, গোলপাতা, হোগলা পাতাসহ মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ। রয়েছে কুমির, মদন টাকসহ হাজারো প্রাণবৈচিত্র্য। শিশু-কিশোর যুব বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষ এসেছেন প্রকৃতির কোলে প্রশান্তির পরশ পাওয়ার আশায়। অবশেষে প্রকৃতির অপরূপ রূপে মুগ্ধ পর্যটকদের যেন ‘শান্ত হইল ব্যথা।’
সুন্দরবন ভ্রমণ উপভোগ করতে শীতের শুরু থেকে (নভেম্বর-জানুয়ারি) পর্যন্ত পর্যটকের পদচারণায় মুখর সুন্দরবনের এই নয়নাভিরাম ভ্রমণ স্পট কলাগাছিয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। সুন্দরবন সংলগ্ন জেলা সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আসছেন এখানে। মেতে উঠছে সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের ওয়াচ টাওয়ারে উঠে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। এক কথায় সবুজের সমরোহ। প্রকৃতির হাতছানি। কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম সেন্টার ভ্রমণে এসে পর্যটকরা কেউ বানরের সঙ্গে খেলায় মত্ত, কেউবা ছবি কিংবা সেলফি তুলেই হারিয়ে যেতে চান প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে।
সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো, মায়াবী শিংওয়ালা সব হরিণ আপনার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে। যদি হাতে মুড়ি বা চিপস জাতীয় খাবার থাকে সেগুলো খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায় হরিণগুলো। লোকালয় থেকে বেশ দূরে বনের ভেতরে এই ট্রেইলগুলো দিয়েই পর্যটকরা পায়ে হেঁটে যায়। এখানে বনজ বৃক্ষের সারিতে নিস্তব্ধতায় ছেয়ে থাকে চারপাশ। তবে সব নীরবতা ভেঙে বানরের ডাক আর ভেঙচিকাটা ভয়ের সঞ্চার করে।
ট্রেইলের আশপাশে এত ঘন বৃক্ষ যে, দৃষ্টিসীমা নেমে আসে কয়েক গজের মধ্যে। আর সঙ্গে তো বাঘের ভয় আছেই। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। ভয় জড়ানো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে রাজধানী ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা শিশু পর্যটক রাইয়ান জানায়, বনের বানরের সঙ্গে খেলা করতে পেরে বেজায় খুশি। বানরকে খাবার খাওয়াতে পেরে আনন্দে আটখানা শিশু রাইয়ান। শুধু রাইয়ান নয়, শ্যামনগরের শিশু আবিদ হাসান, সাতক্ষীরার সুমাইয়া, রাব্বি, মাহাদীসহ অনেকেই আনন্দে আত্মহারা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে বানর-হরিণের সাথে খেলতে পেরে বেজায় খুশি তারা।
সাতক্ষীরার ‘ইটাগাছা ভালোবাসার মানুষগুলো’ নামের একটি সংগঠন থেকে আসা শফিকুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য জন্য আমরা এসেছি। এখানে একবার আসলে বারবার আসতে মন চায়। শহরের কোলাহল থেকে মনের একটু প্রশান্তির জন্য আসি। মনটাও সতেজ হয় আবার প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষাও নেওয়া যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর, আইলা, আম্পানসহ বিভিন্ন ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের অসংখ্য গাছ ভেঙে-উপড়ে মারা যায়। কিন্তু ত্রাণের আশায় সুন্দরবন বসে নেই। প্রকৃতির নিয়মে আবার গড়ে উঠছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভা থেকে আসা পর্যটক ইয়াসিন মোল্যা বাবুল জানান, সাগর কোলে গাছঘেরা সুন্দরবনের নান্দনিক দৃশ্য তাকে বারবার কাছে টানে। আবেগ উজাড় করে সে আওড়ায়,‘কবির ভাষায়- সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে, সার্থক জনম মা গো তোমায় ভালোবেসে।’ পর্যটক ইয়াসিন মোল্যা বাবুল বলেন, সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো। এ বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক আসেন। কিন্তু নদী থেকে কলাগাছিয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে উঠার সময় কাঠের তৈরি পাটাতনটি বড্ড নড়বড়ে। নদীতে জোয়ারের সময় সমস্যা না হলেও ভাটির সময় সমস্যা। তাছাড়া পাটাতনটি কাঠের তৈরি হওয়ায় ভেঙে পানিতে পড়ে তার সাথে আসা অন্তত আটজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে মাহাদী, রাব্বি নামের দুই শিশুসহ নূরুল ইসলাম, রাজু আহমেদ, জাকির হোসেন ও ইয়াহিয়া রয়েছেন। এ ছাড়া সেখানে একজন নিরাপত্তাকর্মীও পানিতে পড়ে আহত হয়েছেন বলে জানান পর্যটকরা।
সাতক্ষীরার ‘ইটাগাছা ভালোবাসার মানুষগুলো’ নামের একটি সংগঠন থেকে আসা জাকির হোসেন ও বাবু বলেন, সাতক্ষীরা থেকে পরিবার-পরিজন, বন্ধুসহ তারা এসেছেন সুন্দরবনের কলাগাছিয়ায়। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষতভাবে ট্রেইল ভেঙে তাদের কয়েকজন নদীতে পড়ে আহত হন। এ সময় পর্যটকদের কাছে থাকা কয়েকটি মোবাইল ফোন নষ্ট হয়েছে। পর্যটকরা কলাগাছিয়া টহল ফাঁড়ি ও ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে উঠার পাটাতনটি পাকাকরণের দাবি জানান।
এব্যাপারে কলাগাছিয়া টহল ফাঁড়ি ও ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা জানান, কলাগাছিয়া টহল ফাঁড়ি ও ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রে উঠার পাটাতনটি পাকাকরণের কাজ চলমান। কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলেই দ্রুত কাজ সম্পন্ন হবে। ইতোমধ্যে শুক্রবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তিনি আরও জানান, পদ্মা সেতু হওয়ার পরে সাতক্ষীরা রেঞ্জে পর্যটকদের আনাগোনা অনেকগুন বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ‘সড়কপথে সুন্দরবন’-স্লোগানটি একটি ব্রান্ডিং।