আবহাওয়ার বিরূপতায় আসন্ন শীতকালে স্বাভাবিকের চেয়ে কম শীত ও বাড়তি বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে বলে আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন। ফলে শীতকালে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণ আসন্ন রবি মৌসুমে বিভিন্ন ফসলে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে ফসলের সবচেয়ে বড় মৌসুম রবি। এ মৌসুমে বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, শীতকালীন সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের ডাল ও তেলবীজ উৎপাদন হয়। শীতকালে কম বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা এসব ফসল উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও এল নিনোর প্রভাবজনিত কারণে আসন্ন রবি মৌসুমে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে ফসলের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়াবিদ এবং কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বরে গড় বৃষ্টিপাত হয় ৯ দশমিক ৬ মিলিমিটার। আর জানুয়ারিতে ৯ ও ফেব্রুয়ারিতে ২৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এছাড়া স্বাভাবিকভাবে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ডিসেম্বরে ২৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জানুয়ারিতে ২৫ দশমিক ২ ও ফেব্রুয়ারিতে ২৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। আর স্বাভাবিকভাবে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ডিসেম্বরে ১৪ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, জানুয়ারিতে ১২ দশমিক ৫ ও ফেব্রুয়ারিতে ১৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নামে। তবে এবার এর ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এল নিনোর প্রভাবে ২০২৩ সালজুড়ে আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত এমন অস্বাভাবিক আচরণ অব্যাহত থাকতে পারে। এ বছর শীতের মৌসুমে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। এছাড়া ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে গড় বৃষ্টিপাত হতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। সূত্র জানায়, এ বছর শীতের মৌসুমে গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। এছাড়া বৃষ্টিপাত থাকবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। আবহাওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়া যায়। দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে বিচ্যুতির মাত্রা সম্পর্কে বলা যায় না। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম হবে কিনা তা প্রক্ষেপণ করা সম্ভব। হয়তো শীত কয়েক দিন কম বা বেশি থাকতে পারে, কিন্তু গড় তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাত থাকবে অস্বাভাবিক। জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টিপাত বেশি বা টানা বর্ষণ হলে ধান ও গমে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের শঙ্কা থাকে। আর এ সময়ে বৃষ্টিপাত হলে নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে আলু উৎপাদনে। কারণ ওই সময়ের মধ্যে আলুর পরিপক্ব অবস্থায় চলে আসার কথা। এছাড়া পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ উৎপাদনেও বড় ধরনের আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে বৃষ্টিপাত। মূলত শীতকালে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে সব ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যদি পানি জমে থাকে। আবার আলুর ক্ষেত্রে বৃষ্টি হলে রোগবালাই দেখা দিতে পারে। এছাড়া বৃষ্টিপাতের পর আলুর সংরক্ষণ সময় কমে যেতে পারে, যার ফলে উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে শাকসবজি ও পেঁয়াজের ক্ষতি হতে পারে। ধান ও গমের শীষ বের হওয়ার সময় বৃষ্টিপাত হলে ব্লাস্টের আক্রমণ দেখা দিতে পারে। বৃষ্টি হলে মরিচের গোড়া পচন রোগ দেখা দেয়। এ কারণে বৃষ্টি হলেও মরিচের দাম বাড়তে দেখা যায়। কিছুদিন পরপর হালকা বৃষ্টি হলে ফসলের জন্য ভালো। কিন্তু এদেশে বর্ষণের যে প্রকৃতি তাতে টানা বৃষ্টি চলতে থাকে। এটি ফসলের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়া রাতে ঠাণ্ডা আর দিনে গরম এমন আবহাওয়া ধানের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। এমনিতেই ফেব্রুয়ারির দিকে যখন তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তখন বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির বেশি হলে ব্লাস্ট প্রকট হতে পারে। যেহেতু বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা অস্বাভাবিক আচরণ করার শঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাই সার্বিকভাবে কৃষককে এখনই দিকনির্দেশনা দিতে হবে। পরিকল্পিতভাবে ফসল উৎপাদন করা গেলে ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সূত্র আরো জানায় চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) রবি মৌসুমে ৫০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ টন। এছাড়া ৩ লাখ ২৩ হেক্টর জমিতে গম, ৪ লাখ ৬২ হাজারে আলু, ৬ লাখ ২৯ হাজারে শাকসবজি, ৬ লাখ ২২ হাজারে ডালশস্য, ১৪ লাখ ২ হাজারে তেলবীজ, ২ লাখ ৬০ হাজারে পেঁয়াজ, ৭৭ হাজারে রসুন ও ১ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে মরিচ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে একটি ঘূর্ণিঝড়ের শঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া যেভাবে বিরূপ আচরণ করছে তাতে কৃষি খাতের ওপর প্রভাব পড়বে। দেশে আবহাওয়ার আগাম সতর্কতার ক্ষেত্রে সক্ষমতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। যেন অঞ্চলভিত্তিক আলাদা পূর্ভাবাস দেয়া সম্ভব হয়। এছাড়া বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে যেসব ফসলের ক্ষতি হচ্ছে সেসব কৃষককে সহায়তা দিতে হবে। সেটা ভর্তুকির মাধ্যমে হোক কিংবা বীমার মাধ্যমে। বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা দিতে হবে। এদিকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলিতে প্রায় চার লাখ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে আমন ধান, বোরোর বীজতলা ও শীতকালীন শাকসবজির ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। এর ক্ষত না শুকাতেই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘মিগজাউম’ নামে ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের বরিশাল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে আঘাত হানতে পারে। এটি হবে এ বছর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া চতুর্থ ঘূর্ণিঝড়। আর শীত বিলম্বিত হওয়ার পেছনে বারবার ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। এখন মৌসুমি বায়ু চলে গেছে। শীত আসবে হিমালয় থেকে আসা উত্তর-পূর্ব দিকের বাতাস থেকে। সে বাতাস আসতে পারছে না। কেননা এরই মধ্যে মিধিলি হয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরেকটা নিম্নচাপ এদিকে আসবে। ফলে উত্তর-পূর্ব দিকের হিমেল বাতাস বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেননা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের বায়ু গরম বাতাস। এ কারণেই শীত আসতে দেরি হচ্ছে। অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বই ভুগছে। তবে ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে এর প্রভাব একটু বেশি। ডিসেম্বর ও জানুয়ারির শুরুর দিকে বৃষ্টিপাত হলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে। আবার জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টিপাত হলে তা ফসলের জন্য আশীর্বাদ। তবে এক্ষেত্রে পানি জমে যাওয়ার মতো বৃষ্টি হলে সমস্যা দেখা দেবে। আবার তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। তবে আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগ আছে কীভাবে জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উৎপাদন করা যায় এবং এর সম্প্রসারণে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।