মাটি হল আমাদের এক অমূল্য সম্পদ। মাটি পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান। শুধু তাই নয় এটি কৃষির মূল মাধ্যম। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি জীব মাটিতে বসবাস করে।
গত ৫ ডিসেম্বও ছিলো বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস। উদ্ভিদের জন্ম বৃদ্ধিতে ও মানবকল্যাণে মৃত্তিকার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিতেই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস নির্ধারণ করা হয়েছে। মৃত্তিকার সঠিক পরিচর্যার গুরুত্ব ও মাটি ক্ষয় সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করতে আন্তর্জাতিক মৃত্তিকা বিজ্ঞান ইউনিয়ন ২০০২ সালে প্রতিবছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে পালনের সুপারিশ করে। বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থা এই সুপারিশ গ্রহণ করে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ পরিষদ ৫ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যাতে প্রাকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে মাটির গুরুত্ব উদযাপন করা যায়। এই দিনটিতে বিশ্বব্যাপী প্রচার মাধ্যমে মাটি ক্ষয়, মাটি দূষণের কারণগুলি বোঝার জন্য সরকার, অলাভজনক গোষ্ঠী, বিজ্ঞানী এবং জনগণকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে কিভাবে মাটি সংরক্ষণ করা যায় সে বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ সয়েল সায়েন্সেস সারা পৃথিবীর মানুষের মাঝে মৃত্তিকা সম্পদ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ২০০২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালন করে আসছে। পরবর্তীতে এর গুরুত্ত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রথমবারের মত জাতিসংঘের এফএও এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা পৃথিবীব্যাপী বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালিত হয়। দেশে এখনো ব্যাপকভাবে পালিত না হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। পৃথিবীর জীববৈচিত্রের মোট ২৫ শতাংশের সরাসরি আবাসস্থল হল মৃত্তিকা। মৃত্তিকার অনুজীব কর্মকান্ড মাটির গুনাগুন এবং কৃষি উতপাদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া সারা পৃথিবীর জীব সমূহের প্রায় ৯০ ভাগই জীবনচক্রের কোন না কোন অংশ মাটিতে অতিবাহিত করে। কৃষি ও পরিবেশগত ঝুঁকিসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে মাটির গুনাগুন হ্রাস পাচ্ছে।
আমরা অনেকেই জানিনা যে, ভূমির উপর প্রাকৃতিকভাবে ১ ইঞ্চি পরিমান মৃত্তিকা গঠিত হতে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নানা কারণে ভূমির উপরিভাগের মাটি যা চাষাবাদ ও বৃক্ষ জন্মাবার মাধ্যম তা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে সয়েল বায়োডাইভারসিটি হ্রাসের কারণের মধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন, কীটনাশক এর অপরিকল্পিত ব্যবহার, ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংস করা, পাহাড়ে জুম চাষ, ইটের ভাটা অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশগত ছাড়পত্র ব্যাতিত প্রচুর পরিমান মাটি ইটের ভাটার ব্যবহার করা হচ্ছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কেননা এটি বিপুল পরিমান ভূমি ক্ষয় ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে সেভাবে এখনো ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা না থাকাতে কৃষির জন্য খুবই উপযোগী জমিকেও অবলীলায় শিল্প কারখানা এমন কি ইটের ভাটা স্থাপনেও ব্যবহৃত হচ্ছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রিসোর্ট তৈরী, এমন কি শিল্প কারখানা পর্যন্ত স্থাপিত হচ্ছে যা মাটির ক্ষয় ও পরিবেশ দুষণ ঘটাচ্ছে।
লবণাক্ততা মাটির উৎপাদনশীলতা ও বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করে এবং কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করে। উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত মাটি বাংলাদেশের অন্যান্য অবক্ষয় সাধিত মাটির মধ্যে অন্যতম। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্য সীমিত জমি থেকে অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে। ক্রমাগত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দেশের নদী-নালা ও জলাশয়ে মাছসহ নানা জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে, মানুষসহ উদ্ভিদের ওপরও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ করে বনভূমি বিনাশ হচ্ছে যা ব্যাপকভাবে ভূমি ক্ষয়ের কারণ। এছাড়া বিগত এক দশকে একাধিক সাইক্লোন ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আমাদের উপকুলীয় জেলা গুলোতে লবনাক্ততা ব্যাপকভাবে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশগত ভারসাম্য কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা প্রায় প্রতিবছরই ঘটছে। এসব এলাকায় পাহাড়ি ঢালে ঘরবাড়ি তৈরি ও ত্রুটিপূর্ণ কৃষিকাজের ফলে সেখানকার মাটির উপরিভাগ আলগা হয়ে যায় ও বর্ষার সময় ধস নামে। বাংলাদেশে প্রতিবছর নদীর তীর ভেঙ্গে ভূমি হারাচ্ছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট নদী দৈর্ঘ্যের মধ্যে দুই থেকে তিন হাজার কিমি নদীর তীর দীর্ঘকাল ধরে ভাঙনপ্রবণ। দেশে নদীর তীর ভাঙনের ফলে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় ভূমিক্ষয়ের কারণে দেশের উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জীবনে দুর্দশা নেমে আসে। প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত হয় বহু মানুষ।
পৃথিবীতে প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে একটি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ জায়গার মাটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৩৩ শতাংশ মাটির স্বাস্থ্যের অবনয়ন ঘটেছে ও আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৯০ শতাংশ মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বলা হচ্ছে যে কোনো জায়গায় দুই-তিন সেমি মাটি তৈরি হতে প্রায় এক হাজার বছর সময়ের প্রয়োজন হয়।
মাটি ক্ষয় বলতে সাধারণত মাটির ওপরের উর্বর অংশ সরে যাওয়া বোঝায়। পানি, বাতাস ও ভূমিকর্ষণ প্রধানত এই তিন কারণে মাটির উর্বর উপরিভাগ সরে যায় ও মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাটিক্ষয় প্রক্রিয়াটি ভূ-প্রাকৃতিক নিয়মে ধীরগতিতে সম্পন্ন হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের কারণেই এই প্রক্রিয়া দ্রুততর গতিতে সংঘটিত হয়ে থাকে।বর্তমানে মানুষের নানা রকম কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে বনভূমি উজাড়, তৃণভূমি ধ্বংস, ঢালযুক্ত জমিচাষ, ভূমি সমতলকরণ, চাষাবাদে যন্ত্রের অধিক ব্যবহার ইত্যাদির কারণে মাটি ক্ষয় প্রক্রিয়া বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যও মাটি ক্ষয় প্রক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ব্যাতীত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সংবিধানের ১৮ক অনুচ্ছেদেও বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্েয, জলাভূমি সংরক্ষণকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। টেকসই পানি, জলবায়ু, পরিবেশ ও ভূমি ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছে সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কৃষি উন্নয়নে সব সময় আন্তরিক। সফল উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি মূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্যও ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। কৃষিতে আমাদের অগ্রগতি অভূতপূর্ব।
মৃত্তিকা আমাদের পরম সম্পদ। বিশ্ব ব্যাপি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় খাদ্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মৃত্তিকার উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য প্রয়োজন মাটির সঠিক পরিচর্যা। লবণাক্ততাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানা সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। দেশের লবণাক্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বিজ্ঞানভিত্তিক টেকসই কৃষির অনুশীলন এবং প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে হবে।
দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় মৃত্তিকা সম্পদের সঠিক ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। ভবিষ্যতে দেশের আবাদি জমির পরিমান আরেও কমবে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। আমাদের কৃষি ও পরিবেশের ওপর লবণাক্ত মাটির বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, কৃষক সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। মাটির অবক্ষয় কিভাবে সর্বোত্তম উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নির্ধারণের জন্য লবণাক্ত মাটি সম্পর্কে আরও বিশদ জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ লক্ষ্যে মাটির অবক্ষয় রোধে বিনিয়োগ ও গবেষণা বাড়াতে হবে। সকল জেলায় মৃত্তিকা গবেষণাগার তৈরীসহ মৃত্তিকার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরন ও জীববৈচিত্র্েয সংরক্ষণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে স্কুল কলেজ পর্যায়ে মৃত্তিকা বিজ্ঞান এবং পরিবেশ বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। (লেখক; সাংবাদিক ও কলামিস্ট)