মৎস্য ঘেরে পানিতে মাছ আর বেড়িতে সারি সারি টমেটো গাছের বাম্পার ফলনসহ সবজি চাষের অপরুপ দৃশ্য দেখতে ছুটে আসছেন বিভিন্ন এলাকার মাছ ও সবজি চাষি সহ সাধারণ মানুষ। উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে গলদা চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছেন রূপসা উপজেলার টিএসবি ইউনিয়নের দক্ষিণ খাজাডাঙ্গা গ্রামের ২৫ জন চাষীর। সেইসাথে আধুনিক প্রযুক্তিতে ঘেরের পাড়ে টমেটো চাষ করে কৃষকরা তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (১ম সংশোধিত) এর মাধ্যমে ২৫ জন চাষীর ২৫টি ঘেরের ৬.৬৬ হেক্টর জমিতে উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে এই গলদা চাষ শুরু হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ঘের মালিক নিজ খরচে ঘের খনন ও ভেড়ি তৈরী করেন। এরপর থেকে আর তার আর্থিক ব্যয় করতে হয়নি। ওই ঘেরে মাছ চাষের উপযোগী করাসহ জলাশয়ের আয়তন মোতাবেক প্রয়োজনীয় গলদার রেনু প্রজেক্ট থেকে প্রদান করা হয় বিনামূল্যে। এক বছর মেয়াদী এ প্রকল্প নিয়মিত তদারকি শেষে এখন ঘের থেকে মাছ তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। ঘেরের মাছে বাম্পার উৎপাদনে হাসি ফুটেছে চাষীদের। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র অনুযায়ী জানা গেছে প্রথম ধাপে ওই ঘের থেকে ৪'শত ৮০ কেজি গলদা তুলে বিক্রি করা হয়েছে। যার বিক্রি মূল্য প্রায় তিন লাখ টাকা। রবিবার (৩ ডিসেম্বর) ২৫টি ঘেরের মালিকদের নিয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি ওই গ্রামের মোঃ আনছার আলী মোড়লের ঘের থেকে প্রথম ধাপে ৭৮ কেজি গলদা চিংড়ি ও ৩০ কেজি মাছ ধরা হয়। যা বিক্রি হয় ৫৯ হাজার টাকায়। তার ঘেরে থাকা মাছের চার ভাগের একভাগ মাছও ধরা হয়নি। জালের একটি টানে যা উঠেছে তা থেকে বেছে বেছে বড় মাছ বাজার জাত করা হয়। শুধু মাছ নয়, তিন দিনে ঘেরের ভেড়িতে লাগানো টমেটো বিক্রি করেছেন তিনি ৫২ হাজার টাকা। এব্যাপারে আনছার আলী বলেন, উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে গলদা চাষের এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রথম দিকে মৎস্য অফিসের বাপী স্যার আমাদের বললে আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপরও উনার কথামত ঘেরের মাটি খনন, বেড়ি তৈরি ও বেড়িতে সবজি খামার করা বাবদ একলাখ টাকা খরচ করি। মৎস্য অফিসের পরামর্শ ও দিক নির্দেশনায় এখন ভালো ফল পাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, আমার ঘের খননের পর সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট এর মাধ্যমে ঘেরের জন্য ১৫৪ কেজি ৫০০ গ্রাম চুন, ২০৬ কেজি ব্লিচিং পাউডার, ৯২৭ কেজি ৫০০ গ্রাম চিংড়ির খাদ্য, ৪৬.৩৫ কেজি মোলসেস, ৩৬ কেজি চালের কুড়া, ০.৪১২ কেজি ইষ্ট পাউডার, ০.৪১২ কেজি প্রোবায়োটিক ও ২০ হাজার ৬০০পিস গলদার রেনু দেওয়া হয়। মৎস্য অফিসের মাধ্যমে বিনামূল্যে এসব সাপোর্ট না পেলে এতটাকা ব্যয় করে ঘের করা কোনভাবে সম্ভব ছিলেনা। শুধু আনছার মোড়ল নয়, এখানকার মৎস্য চাষী সৈয়দ সোহেল রানা, মোঃ মিরাজুল ইসলাম তরফদার, আঃ রাজ্জাক মোড়ল, মোঃ হামিদ মোড়ল, জান্নাতুন নাঈম, মোছাঃ পূর্নিমা বেগম, মোছাঃ নূর নাহার বেগম, সুমনা খানমসহ ২৫ জন চাষীর চোখে-মুখে এখন আনন্দের হাসি। একই প্রযুক্তিতে গলদা চাষ করে তারা নিজেদের ভাগ্য বদলেছে। মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২হাজার ৪৬৬ কেজি চুন, ৩ হাজার ২৮৮ কেজি ব্লিচিং পাউডার, ১৪ হাজার ৮০৩.৩২ কেজি চিংড়ি খাদ্য, ৭৩৯.৮ কেজি মোলাসেস, ৫৭৫.৪ কেজি চালের কুড়া, ৬.৫৭৮ কেজি ইষ্ট পাউডার, ৬.৫৭৮ কেজি প্রোবায়োটিক, ৩লাখ ২৮হাজার ৮০০ পিস গলদা রেনু, ১ সেট মাটি ও পানি পরীক্ষার কীট/যন্ত্র, ১টি পোর্টেবল পিসিআর মেশিন, ৫টি রেজিস্ট্রার, ১টি সাইনবোর্ড ও ২টি ডিজিটাল স্কেল চাষীদের বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। রূপসা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার বাপী কুমার দাস বলেন, সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (১ম সংশোধিত) এর আওতায় রূপসা উপজেলার দক্ষিণ খাজাডাঙ্গা গ্রামে ২৫টি ঘেরের সমন্বয়ে চাষী ভাইয়েরা নিজেদের অর্থায়নে ঘের সংস্কার, ঘেরের পাড়ের প্রশস্ততা ও নার্সারীর আয়তন বৃদ্ধি করেন এবং বায়োসিকিউরিটি মেইনটেইন করেন। এসব ঘেরের প্রতিটির আয়তন ৩০ থেকে ১৫০ শতক। পরবর্তীতে আমাদের প্রজেক্ট থেকে চাষকালীন সময় মাছের পোনা, খাদ্য, প্রিবায়োটিক, প্রোবায়োটিক প্রদান করা হয়। যার ফলে মাছ চাষ করে ২৫ জন চাষীর দারিদ্রতা নিরসন হয়েছে। তিনি বলেন এই উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে মাছ চাষের ফলে মাছের উৎপাদন বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য চাষীরা এই পদ্ধতি অবল্বন করলে একদিকে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবে অন্যদিকে দেশের আমিষের চাহিদা মিটিয়ে এসব মাছ বিদেশে রপ্তানী করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি সম্ভব হবে।