শীতের আগমনে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু ডিসেম্বরের ডেঙ্গু পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায়নি। এর মধ্যে ঢাকাতে ৯৪৮ জন এবং সারা দেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) ৬৯৩ জন মারা যান। চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ১৫ হাজারেও বেশি মানুষ এবং একই সময় পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৬ জনেরও বেশি মানুষে। দেশে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর রেকর্ড আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু মৃত্যু নয়, আক্রান্তেও আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর ডেঙ্গুর এই প্রকোপ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু, তবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, সঠিক সময়ে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় এবং তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে এ বছর ডিসেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, এডিস মশা বেঁচে থাকার জন্য যে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা প্রয়োজন, তা এখনো অনুকূলে। এখনো শীত তেমন না পড়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ আছে। তবে শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। আগামী বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে আশঙ্কা করে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, শীতের কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার পর সিটি করপোরেশন যদি কাজ বন্ধ করে দেয়, তাহলে আগামী বছর ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। সিটি করপোরেশনের যেসব কাজ করা দরকার, তা তেমনভাবে না করায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান বলেন, অক্টোবরে বৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া তাপমাত্রা অনুকূলে থাকায় এডিস মশার ঘনত্ব রয়ে গেছে, মশা তেমনভাবে কমেনি। শীত অনেক দেরিতে আসছে। এসব কারণে ডিসেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। তিনি বলেন, রাজধানীতে অনেক নির্মাণ কাজ হচ্ছে। এসব জায়গায় পানি জমে থাকে। সিটি করপোরেশনগুলো লোক দেখানো কিছু কাজ করে। তারা যে ক্রাশ কর্মসূচী চালায়, এগুলো তেমন কার্যকর না। কারণ এগুলো ধারাবাহিকভাবে করা হয় না। ডেঙ্গুর যে হটস্পট তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ওই সব এলাকা চিহ্নিত করতে পারলে মশা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকতো। সংক্রমণ বন্ধ করতে পারলে প্রকোপ এত বেশি হতো না। ডেঙ্গু আমাদের দেশে সারা বছর স্থায়ী হতে পারে জানিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, যখন সংক্রমণের হারে ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়, গণমাধ্যমে লেখালেখি বেশি হয়, তখন সিটি করপোরেশনের তৎপরতা দেখা যায়। তার আগে তারা তেমন কাজ করে না। সারা বছর কাজ না করলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে তিন কারণে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি। এগুলো হলোÑ আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুহার নির্ণয় না করা, প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্ত করতে না পারা এবং মেডিকেল কলেজের বাইরে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতি। টিআইবি জানায়, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া প্রতিবারই ডেঙ্গুর মৌসুম বর্ষাকাল এলে সিটি করপোরেশন নানা উদ্যোগ নেয়। তবে কার্যকরী উদ্যোগ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে ডেঙ্গুকে মৌসুমি ধরা হলেও গত বছর থেকে এবছর বিরতিহীনভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন দেশের মানুষ। তাই সামনের বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের বড় ধরনের ঝুঁকি আসার আগেই সারাদেশে ডেঙ্গু নিধন কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, শীতকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কিছুটা কমতে পারে। তবে এতে খুশি হওয়ার কারণ নেই। সামনের বছর ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়লে এবং ডেঙ্গুর নতুন ধরনে আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে। তাই প্রয়োজন টেকসই পরিকল্পনা। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা জরিপ, হটস্পট চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া, ডেঙ্গু সার্ভেইল্যান্স প্রক্রিয়া সম্পর্কিত নির্দেশনা আরও জোরদার করতে হবে। একই সঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে। শীতকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে না- এমনটিই ধারণা করা হয়। কিন্তু বিগত বছরে দেখা যায় শীতকালেও রোগী পাওয়া গেছে, চলতি বছরেও তা-ই। বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ধারণা করা হলেও এখন সারাবছর ডেঙ্গুরোগী পাওয়া যাচ্ছে। এবছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। সামনের বছর এটি আরও বাড়তে পারে। তবে সামনে বছরও ডেঙ্গুর একই ধরনে (সেরোটাইপ-২) আক্রান্ত হলে রোগী কমে যাবে। কিন্তু ধরন বদলে সেরোটাইপ-১ বা সেরোটাইপ ৪ দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি হবে।