১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদার মুক্ত হলও সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৯ মাসে সৈয়দপুর উপজেলা সদরকে ‘নিউ বিহার’ হিসেবে ঘোষণা দেয় অবাঙ্গালিরা। অবাঙ্গালি অধ্যুষিত সৈয়দপুরে সেনানিবাস থাকার সুবাদে পাক সেনাদের সঙ্গে অবাঙ্গালিদের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে। পাকসেনাদের সহায়তায় একশ্রেণির অবাঙ্গালি সৈয়দপুর শহর ছাড়াও নীলফামারী জেলার প্রতিটি উপজেলায় প্রচুর লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। যার স্মৃতি সৈয়দপুরে এখনো বিদ্যমান।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা.জিকরুল হকের নেতৃত্বে গোটা সৈয়দপুরে সমস্ত বাঙ্গালি এক কাতারে সামিল হয়। সৈয়দপুর সেনানিবাসের প্ররোচনায় কতিপয় অবাঙ্গালী প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গোটা শহরে তান্ডব চালায়।
২৩ মার্চ রাতে পাকসেনাদের প্ররোচণায় অবাঙ্গালিরা বাঙ্গালি পরিবারদের ওপর হামলা চালিয়ে লাখ লাখ টাকার সম্পদ লুটসহ নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ করে। গোলাহাট এলাকায় অবাঙ্গালিদের হাতে আহত হয় কয়েক শতাধিক মানুষ। এ ঘটনায় গোটা এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হলে নীলফামারী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর জেলার খানসামা, চিরিরবন্দর,পার্বতীপুর এলাকার হাজার হাজার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং সৈয়দপুর শহর ঘেরাও করার উদ্যোগ নেয়। ফলে বাঙ্গালি ও অবাঙ্গালিদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। সৈয়দপুর শহরের বাঙ্গালিদের উদ্ধারের জন্য অস্ত্রহাতে এগিয়ে আসেন পাশের চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকডিহি ইউপি চেয়ারম্যান মাহাতাব বেগ। অবাঙ্গালি ও খান সেনাদের সঙ্গে গোলাগুলির একপর্যায়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে শহীদ হন। মূলত তিনিই সৈয়দপুরের প্রথম শহীদ।
২৪ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাঃ জিকরুল হক, তুলসীরাম আগরওয়ালা,ডাঃ সামছুল হক, ডাঃ বদিউজ্জামান,ডাঃ ইয়াকুব আলী,যমুনা প্রসাদ কেডিয়া,রামেশ্বরলাল আগরওয়ালা,নারায়ন প্রসাদ,কমলা প্রসাদ প্রমুখকে সৈয়দপুর সেনানিবাসে হাত পা বেঁধে রাখা হয় এবং ১২ এপ্রিল তাদের চোখ-মুখ বেঁধে রংপুর সেনানিবাসের উত্তর পাশে উপশহরে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার পদস্থ কর্মচারীদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাকসেনা ও তাদের অবাঙ্গালি দোসরদের হাতে নিহত হন অসংখ্য রাজনীতিক,ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ।
১৯৭১ সালের ১৩ জুন মুক্তিযুদ্ধকালীন সৈয়দপুর শহরে সবচেয়ে বৃহৎ গণহত্যা সংঘঠিত হয়। এ দিন শহরের ৪৪৮ জন মাড়োয়ারী পরিবারের সদস্যকে ভারতের হলদিবাড়ি সীমান্তে পৌঁছে দেয়ার নামে ট্রেনে তুলে রেলওয়ে কারখানার উত্তর প্রান্তে গোলাহাটে সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে লুটে নেয়া হয় তাদের সর্বস্ব। শিশুদের বায়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয়। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর ভারতের হীম কুমারি ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে প্রবেশ করে সৈয়দপুর আক্রমণ করলে অবাঙ্গালি ও খান সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এদিন সৈয়দপুর হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়। সুতারাং সৈয়দপুর হানাদার মুক্ত হয় দেশ স্বাধীনের দুদিন পরে। আজও সৈয়দপুরে কতিপয় অবাঙ্গালীদের আচরণ ১৯৭১ সালের পাক হানাদার বাহিনীর মত।
এ বিজয়ে মুক্তি পাগল হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে প্রবেশ করে। এ দিন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম কাজী ওমর আলী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বে শহরে আনন্দ মিছিল বের হয়। ওইদিন নেতারা প্রথম সৈয়দপুর পৌরসভা কার্যালয়ে ও আওয়ামী লীগ অফিসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। দিবসটি পালনে ১৮ ডিসেম্বর রাতে প্রজম্ম-৭১ আলোচনা সভা ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, শহীদ পরিবারগুলো মিলাদ মাহফিল ও কাঙালি ভোজের আয়োজন করে।