শাহিদার মৃত্যুকে ঘিরে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে উপজেলার নোয়াগাঁও ও কালীকচ্ছ মধ্যপাড়া গ্রামে। সেলিম মিয়ার এক ছেলে আল-আমিন। তাই ছোটকাল থেকে মা বাবার আস্কারায় বড় হয়েছে সে। তার উশৃঙ্খল জীবন-যাপনে কখনো বাঁধা দেয়নি পরিবার। তাই প্রেমকে সহজে মেনে নিয়ে শাহিদাকে বিয়ে করিয়েছিল। তাদের বাড়ির কাছেই ঋষী বাড়িতে রয়েছে ছুলামদ উৎপাদনের কারখানা। নিয়মিত সেখানে অবাধ যাতায়ত ও মদ পান ছিল আল-আমিনের নেশা। খুব দ্রƒতই আল-আমিনের ঘর আলোকিত করে আসে দুই শিশু সন্তান। বিয়ের প্রায় পাঁচ বছর পরই রূপ পাল্টে যায় আল আমিনের। ভালবাসার শাহিদাকে আর ভাল লাগে না। পর নারীতে আসক্ত হয়ে পড়ে সে। তাদের বাড়ি থেকে প্রায় ২-৩ কিলোমিটার উত্তরে দৌলত পাড়ার এক অবিবাহিত মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় আল আমিন। শাহিদার পরিবারের লোকজন জানায় ওই মেয়েটির নাম ছামিনুর বেগম (২৬)। আশা নামে ডাকে সবাই। দিনে রাতের অধিকাংশ সময় আশার সাথে আল আমিনের ফোনালাপের রেকর্ডও পাওয়া গেছে। দু’জনের কথায় শুধু ভালবাসা আর যৌন শুড়শুড়ির ইশারা। কথা রেখেছে আল আমিন। এক রেকর্ডে আল আমিন আশাকে বলেছিল ‘স্ত্রী সন্তানসহ পৃথিবীর সবকিছু ভুলে থাকতে পারবে। কিন্তু আশাকে ভুলে থাকতে পারবে না।’ আশা’র একটু বাঁকা কথার উত্তরে আল আমিন বলে যে কোন দূর্ঘটনার দায় দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে। তাই পুলিশের ধারণা যৌতুকের চাহিদা মিটাতে না পারা ও পরকীয়ার কারণেই শেষ পর্যন্ত খুন হলো গৃহবধূ শাহিদা। মামলা, শাহিদার পরিবার, কলরেকর্ড ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মূলত যৌতুক ও পরকীয়ার কারণেই স্ত্রী শাহিদাকে নির্মম নৃশংস ভাবে আগুনে পুঁড়িয়ে হত্যা করেছে আল-আমিন। মায়ের সাথে আগুনে পুঁড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে এখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে শিশু আলিফা (০২)। পথের কাঁটা দূর করেছে সে। কারণ আশা নামের অবিবাহিত মেয়েটির প্রতি তার অস্বাভাবিক দূর্বলতা মুঠোফোনের রেকর্ডেই প্রমাণ করে। একাধিক রেকর্ডে জানা যায়, আজ থেকে ৩-৪ বছর আগে আশার সাথে মুঠোফোনে পরিচয় হয় আল আমিনের। প্রথম দিকে একটু পিছিয়ে থাকলেও এক সময় আল আমিনের ফোন রিসিভ করে দীর্ঘ সময় আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকে দু’জনে। আশা আলআমিনকে কখনো চাচা আবার কখনো ভাই বলে সম্ভোধন করে। ভালবাসা ভাললাগার কথা বলতে বলতে যৌন শুড়শুড়ি পর্যন্ত গড়ায়। আশার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় কয়টি তিল আছে। তারা কখন কোথায় গেছে। একে অপরের সাথে রাত্রি যাপনের তর্কেও জড়িয়েছে তারা। মুঠোফোনে সেসব কথা বলাবলি করতে শোনা গেছে। এক পর্যায়ে আল আমিনকে আশা বলে, ‘আমি আর ফোন দিব না। তুমি আর আমাকে ফোন দিও না। মন থেকে আমাকে বাদ দাও।’ আল আমিন মুঠোফোনে আশাকে বলে, তুমি আমাকে তোমার সাথে থাকার কথা বলেছ। তোর দেহটারে আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছে। তোর সাথে আমার মনের মিল হইছে। তাই দেখেছি। আসমানে তারা ওঠলে পাড়া পড়শি দেখে। তুই আমাকে তোর আব্বা, মা, চাচা, চাচি তাদের জন্য ভুলে যেতে পারবি। কিন্তু আমি তোকে কোনদিনও ভুলে থাকত পারব না। আমি তোরে বউ বানাইছি। বউ বানাইয়া ছাড়ুম। আমি তোমারে (আশাকে) না পাইলে দূর্ঘটনা ঘটাব। এর দায় তোমাকে নিতে হবে। আমি তোমার জন্য স্ত্রী সন্তানসহ সবকিছু ত্যাগ করতে পারব। তোমাকে ভুলে থাকতে পারব না। মনে রাখবে আমি নষ্ট হইছি, তোমাকে নষ্ট করে ছাড়ব। আশা এক সময় আখিঁতারা গ্রামে ভাবীর বাড়িতে অবস্থানের কথা আল আমিনকে জানায়। তখনই আশার কাছে ছুটে যেতে নানা আকুতি করতে থাকে আমিন। নিষেধ করায় আশাকে মুঠোফোনেই অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করে আল আমিন। নিহত শাহিদার ভাই আবেদসহ পরিবারের অন্যরা জানায়, সারা দিন কাজের নামে ঘুরে ফিরে পরকীয়ায় মজে থাকে। রাতে বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর কাছে যৌতুকের টাকা চেয়ে গালমন্দ ও মারধর করে। আল আমিনের পক্ষ নিয়ে শাহিদার উপর নির্যাতন চালায় শ্বশুর শ্বাশুড়ি ও পাখি নামের ননদ। স্থানীয় একাধিক নারী পুরূষ বলেন, আশার পরকীয়ায় গভীর ভাবে মত্ত হয়ে গিয়েছিল আল আমিন। তাই পথ পরিস্কার করে আশাকে কাছে পাইতেই নিরপরাধ শাহিদাকে পৈশাচিক ভাবে খুন করেছে আল আমিন। তবে আল আমিনের একাধিক স্বজন জানান, অভাবের সংসারে দেন দরবার লেগেই থাকত। শাহিদার শরীরে কে আগুন দিয়েছে সেটা কিন্তু পরিস্কার নয়। কারণ আগুনে গুরূতর আহত ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন আছে আল আমিনও।
শাহিদার দাফন বাবার বাড়িতে: ঘটনার পরই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে শাহিদার শ্বশুর শ্বাশুরিসহ সকলেই। বসত ঘরে এখন ঝুলছে তালা। তাদের কোন স্বজন শাহিদাকে একনজর দেখতে হাসপাতালেও যায়নি। তাই গত মঙ্গলবার শাহিদার মরদেহ বাবার বাড়ি নোয়াগাঁও গ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে সেখানেই দাফন করা হয়েছে শাহিদার লাশটি। দাফন কাজেও আসেননি আল আমিনের কোন স্বজন ।
শিশু জুবাইদের অবস্থান অজানা: ঘটনার দুইদিন পেরিয়ে গেলেও শিশু সন্তান জুবাইদকে এখনো পাননি শাহিদার ভাই ও স্বজনরা। ঘটনার দিন ফুফু পাখির কাছে জুবাইদকে দেখেছিলেন তারা। মায়ের লাশ দাফনের সময়ও জুবাইদ ছিল অনুপস্থিত। এ বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন শাহিদার বাবার বাড়ির লোকজন। তাদের শঙ্কা আল আমিনের স্বজনরা জুবাইদের বড় ধরনের কোন ক্ষতি করবে না তো? সরাইল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ এমরানুল ইসলাম বলেন, এই হত্যাকান্ডের পেছনে যৌতুক তো আছেই। পরকীয়া যে দায়ী এর বেশ কিছু আলামত ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। পুলিশ প্রহারায় ঢাকায় চিকিৎসা চলছে আসামী আল আমিনের। তাকে সরাইল আনতে ১০-১২ দিন সময় লাগতে। পিও ভিজিটের পর তদন্ত করব। ওদিকে আল আমিনের তালাবদ্ধ ঘরের ভেতরও ভালভাবে তদন্ত করব। প্রসঙ্গত: যৌতুকের টাকা না দেওয়ায় গত সোমবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শাহিদার শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে হত্যা করেছে পাষন্ড স্বামী আল আমিন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার ভোরে শাহিদার মৃত্যু হয়।