দেশের রেল যোগাযোগব্যবস্থাকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। দেশেরে ৬৪ জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যানের কাজ চলমান রয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবরের শুরুতেও রেল নেটওয়ার্কের আওতায় ছিল দেশের ৪৩টি জেলা। বর্তমানে কক্সবাজারসহ আরও পাঁচটি নতুন জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে রেল কর্তৃপক্ষ। যোগাযোগের এই সহজ, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়ে বর্তমানে ৪৮ জেলায় পৌঁছে গেছে। সারা দেশে এখন রেলপথ আছে তিন হাজার ৯৩ কিলোমিটার। কিন্তু কম জনবলের কারণে বিস্তৃত নেটওয়ার্কে প্রান্তিক পর্যায়ে অপারেশন কার্যক্রম যথাযথভাবে চালানো যাচ্ছিল না। পরিকল্পনার আওতায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিদ্যমান দুইটি অঞ্চলকে বিকেন্দ্রীকরণ করে চারটি অঞ্চল ও চারটি বিভাগকে বিস্তৃত করে হবে আট বিভাগে ভাগ করা হলে রেল খাতকে পরিচালনার সমস্যা দূর হবে। কিন্তু পরিকল্পনা নেওয়ার দীর্ঘ এক দশকেও সেটি বাস্তবায়নের মুখ দেখা যায়নি। তবে এক দশক পরে এসে এখন বাংলাদেশ রেলওয়েকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে নেওয়া পদক্ষেপ গতি পাচ্ছে। জানা গেছে, এক দশক আগে ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যে এই অনুশাসন প্রদান করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুটি কমিটি গঠন করেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক এ সংক্রান্ত সুপারিশ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সভায় উত্থাপন করেন। এতে একটি কমিটি চারটি অঞ্চল ও পাঁচটি নতুন পরিচালন বিভাগ এবং আরেকটি কমিটি চারটি অঞ্চল ও আটটি পরিচালনা বিভাগে বিভক্তির প্রস্তাবনা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অঞ্চল ও বিভাগ বিভক্তির চূড়ান্ত প্রস্তাবনা দেয় গঠিত কমিটি। একইসঙ্গে জনবল কাঠামোতেও পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে রেলওয়েতে দুটি অঞ্চল ও চারটি বিভাগে ৪৭ হাজার ৬৩৭ অনুমোদিত জনবল আছে। অঞ্চল ও বিভাগ বাড়ানোর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক ৭ হাজার ৩০৯ জনবল বাড়িয়ে ৫৪ হাজার ৩৪৬ করার প্রস্তাব করেন। রেলওয়ে সূত্র জানায়, এক প্রস্তাবনায় চট্টগ্রাম ও সিলেটকে পরিচালনা বিভাগ রেখে চট্টগ্রামের সিআরবি পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর, পাকশী ও লালমনিরহাটকে পরিচালনা বিভাগ রেখে রাজশাহীকে পশ্চিমাঞ্চলের সদর দপ্তর, ময়মনসিংহ ও ঢাকাকে পরিচালনা বিভাগ রেখে ময়মনসিংহকে উত্তরাঞ্চলের সদর দপ্তর, রাজবাড়ী ও খুলনাকে পরিচালনা বিভাগ রেখে ফরিদপুরকে দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। এ প্রস্তাবনার আলোকেই অঞ্চল ও বিভাগের বিভক্তি চলতি সরকারের মেয়াদেই চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর খুলনা নাকি ফরিদপুর হবে তা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হলে তা থমকে যায়। ২০২৩ সালের মার্চে খুলনা অঞ্চলের সংসদ সদস্য শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল ও শেখ হেলালউদ্দিন খুলনায় দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করতে মন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৪ জুন রেলওয়ে মহাপরিচালককে প্রতিবেদন দিতে বললে সেপ্টেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে খুলনাকেই দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে এখন ফরিদপুরের বদলে খুলনাকে দক্ষিণাঞ্চলের সদর দপ্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, এসব পরিকল্পনা অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। যেহেতু রেল বর্ধিত হচ্ছে তাই অঞ্চল ভাগ করার চিন্তাভাবনাও রয়েছে। আস্তে আস্তে সেটি করা হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার জনস্বার্থে রেলসেবার মান বাড়াতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ৭৯৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ, ৮৯৭ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ, ৮৪৬ কিলোমিটার বিদ্যমান রেললাইন পুনর্বাসন, ৯টি গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু নির্মাণ, লেভেল ক্রসিং গেটসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আইসিডি নির্মাণ, ওয়ার্কশপ নির্মাণ, ১৬০টি নতুন লোকোমোটিভ, ১ হাজার ৭০৪টি যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহ, আধুনিক রক্ষণাবেক্ষণ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, ২২২টি স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থার মানোন্নয়ন, নতুন আইসিডি নির্মাণসহ রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত রেলপথ ছিল দেশের ৪৩টি জেলায়। ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধনে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হয় আরও তিন জেলা মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর। গত ১ নভেম্বর খুলনা-মোংলা রেলপথ উদ্বোধনের মধ্যে ৪৭তম জেলা হিসেবে পুনরায় যুক্ত হয়েছে বাগেরহাট। এর আগে খুলনা-বাগেরহাট রেলপথ বন্ধ হলে রেল সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এ জেলা। সর্বশেষ ১২ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের উদ্বোধনের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজার সংযুক্ত হয় রেল নেটওয়ার্কে। সারা দেশকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ১৬টি জেলায় রেলপথ সংযোগ হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০৪৫ সালের মধ্যে এই ১৬ জেলাকেও রেলপথের আওতায় আনতে চায় সরকার। জেলাগুলো হলো—নড়াইল, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, মাগুরা, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি, শেরপুর, মানিকগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর। এর বাইরে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি। রেল সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা জেলাগুলোর মধ্যে ২০২৪ সালে পদ্মা রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের উদ্বোধন হলে যুক্ত হবে নড়াইল ও মাগুরা জেলা। তারপর ধীরে ধীরে রেলওয়ের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে যুক্ত হবে বাকি জেলাগুলো। এসব জেলাকে রেলপথে সংযুক্ত করতে বিভিন্ন প্রকল্পের সমীক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি জেলাগুলোও রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে জানিয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বর্তমানে যেসব প্রকল্পের সমীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে, সেসব প্রকল্পের আওতায় রেলপথ নির্মিত হলে আটটি জেলা রেল সংযোগের আওতায় আসবে। এই আট জেলা হচ্ছে- সাতক্ষীরা, বরিশাল, রাঙামাটি, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মেহেরপুর। এ ছাড়া রেলওয়ের বিদ্যমান মাস্টারপ্ল্যান সম্পন্ন হলে ২০৪৫ সালের মধ্যে বাকি চার জেলা লক্ষ্মীপুর, শেরপুর, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি রেল সংযোগের আওতায় আসবে। তখন দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলা ছাড়া বাকি সব জেলা দেশের রেল সংযোগে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, রেল যোগাযোগব্যবস্থাকে জনবান্ধব ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকার ৩০ বছর (২০১৬-২০৪৫) মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। ছয়টি পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ের এই মাস্টারপ্ল্যানে ২৩০টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে, দেশের সব জেলা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে।