বাংলাদেশ তিন ধরনের পেঁয়াজ উৎপাদন করে। বাল্ব পেঁয়াজ (বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪ এবং লালতীর কিং), অল্প পরিমাণ গ্রীষ্মকালীন বারি পেঁয়াজ-৫ এবং স্থানীয় জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ। এভাবে বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজ চাষ করেও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ দেশে চাল ও গম সংরক্ষণের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর গুদাম রয়েছে। আলু রাখার জন্য রয়েছে হিমাগার। কিন্তু পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য এখন পর্যন্ত দেশে কোনো হিমাগার বা সংরক্ষণাগার গড়ে ওঠেনি। ফলে সংরক্ষণের সময় অতিবৃষ্টি হলে পেঁয়াজে ছত্রাক লেগে এবং শিকড় গজিয়ে তা দ্রুত তা নষ্ট হয়ে যায়। কৃষি খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন মূলত সংরক্ষণ দুর্বলতা পেঁয়াজ উৎপাদনের সাফল্যকে মলিন করে দিচ্ছে। তাই চাহিদার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি হলেও প্রতি বছরই পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৬ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। এবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে ৩৫ লাখ টন পেঁয়াজ। পেঁয়াজের সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে বিভিন্ন ধাপে অপচয় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাদে গত বছর নিট উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ ৫৩ লাখ মেট্রিকটন। বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। সূত্রমতে, বাড়তি উৎপাদন করলেও সংরক্ষণের অভাবে ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেই ঘাটতি পূরণ করতে সরকারকে আমদানি করতে হয়। অনেক কৃষকরা তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলেও তা বেশি দিন রাখা যায় না। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য যে তাপমাত্রা দরকার সেটা না পাওয়ায় পেঁয়াজ পচে যায়। তখন তাদের লোকসানে পড়তে হয়। এ কারণে উৎপাদন মৌসুমে অনেক সময় কম দামে সব পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন কৃষকরা। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজ নিয়ে সঠিক গবেষণা, সম্প্রসারণ, পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। তথ্য মতে, ভারত, চীন, মিসরের পেঁয়াজ দুই থেকে তিন মাসের বেশি সংরক্ষণ করা যায় না। সেখানে বাংলাদেশের পেঁয়াজ পাঁচ থেকে সাত মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মার্চে বাংলাদেশের মাঠ থেকে পেঁয়াজ ওঠা শুরু হওয়ার পর তা নভেম্বর পর্যন্ত বাজারে বিক্রি হয়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূলত বিদেশি আমদানি পেঁয়াজের ওপরে নির্ভর করে দেশের বাজারের চাহিদা মেটানো হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। চাষিদের অভিযোগ, কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সঠিক দিক নির্দেশনা না পাওয়ায় এত পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। তবে চাষীদের সহযোগিতা করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এতে ব্যাপক সাফল্য মিলেছে। গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টন। দুই বছরে আগে যেখানে উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টনের মতো, এখন উৎপাদন হচ্ছে ৩৫ লাখ টনের মতো। বিপরীতে দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। এর ফলে দেশে পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায় বলে আমদানি করতে হচ্ছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের যেসব জেলায় পেঁয়াজ চাষ হয়, সে সব জেলায় কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন না থাকায় পেঁয়াজ আবাদে কৃষক আগ্রহী নয়। অথচ কোল্ড স্টোরেজ থাকলে নষ্ট হওয়া কমে যেত। আর এমন সুবিধা পেলে কৃষকরা আরও পেঁয়াজ আবাদে আগ্রহী হতো। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে যখন পেঁয়াজ মাঠ থেকে তোলা হয় তখন তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। কোল্ড স্টোরেজে রাখতে হলে এর তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হবে। একটি কোল্ড স্টোরেজকে এই তাপমাত্রা নামিয়ে আনতে ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগে। এতে বিদ্যুৎ খরচ বেশি হবে। যা ব্যয়বহুলও। সূত্রমতে, কৃষি মন্ত্রণালয় ১৩৩টি মডেল ঘর (কৃষকরা যেভাবে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে সেভাবেই) নির্মাণ করে দিয়েছে । একটা ঘরে এক মৌসুমে ১০ টন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। এ ছাড়া আরও ১১২টি ঘর তৈরি করা হবে। সবমিলে ২৫০টি ঘরে ২ হাজার ৪৫০ টন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে। তবে মোট উৎপাদনের তুলনায় এই সংরক্ষণ খুবই নগণ্য। সূত্রমতে, দেশে চাহিদার বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হওয়ার পরেও পেঁয়াজের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে প্রতিনিয়তো। এর ফলে পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হয়, নানান রকম রাজনীতি শুরু হয়। পাশের দেশ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। ভারত অনেক সময় রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে, এতে চরম সংকট দেখা দেয়। সেজন্যই সরকার পেঁয়াজ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি ভাবে ন্যায্য মূল্যে পেঁয়াজ কিনে তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে একদিকে যেমন কৃষক বাঁচবে অন্যদিকে হাতের নাগালেই থাকবে পেঁয়াজের দাম।