আউট হয়ে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সময়ই আবেগাপ্লুত মনে হচ্ছিল ডেভিড ওয়ার্নারকে। ম্যাচ শেষে যখন দাঁড়ালেন মাইক্রোফোনের সামনে, বারবার ধরে এলো তার কণ্ঠ, ছলছল করে উঠল চোখ। আবেগের প্রবল জোয়ার সামাল দিয়েই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার জানালেন তার বিদায়ী প্রতিক্রিয়া। রেকর্ড-অর্জন তার কম নেই টেস্ট ক্যারিয়ারে। তবে লোকের হৃদয়ে তিনি জায়গা ধরে রাখতে চান রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদায়ী একজন হিসেবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা বেশ আগেই দিয়েছিলেন ওয়ার্নার। বিদায়ে সেই দিনটিও এসেই গেল। ক্যারিয়ারের শেষ দিনেও চেনা সেই দাপুটে ব্যাটিংয়ে ফিফটি করে দলকে জয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে শেষবারের মতো মাঠ ছেড়ে যান এই সংস্করণে। ঘরের মাঠে পরিবার-পরিজন আর নিজ শহরের দর্শকের সামনে শেষ ইনিংসেও দারুণ ব্যাট করে বিদায়, ম্যাচ জিতে দলের ৩-০ ব্যবধানের জয়, সব মিলিয়ে এভাবে শেষ করতে পারায় দারুণ আপ্লুত ওয়ার্নার। “স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ব্যাপার এটি (এমন বিদায়)। ৩-০ ব্যবধানের জয় এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের দুর্দান্ত ১৮ মাস বা ২ বছর পথ ধরে এভাবে শেষ করতে পারা দারুণ। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে জয়, সিরিজ ড্র করে অ্যাশেজ ধরে রাখা, (ওয়ানডে) বিশ্বকাপ জয় এবং এরপর এখানে ফিরে ৩-০ ব্যবধানে জয় অসাধারণ সব অর্জন এবং গ্রেট এক দল ক্রিকেটারের সঙ্গে এখানে থাকতে পেরে আমি গর্বিত।” ম্যাচের ভাগ্য অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আগের দিন। তার পরও টেস্টের চতুর্থ দিনে গ্যালারিতে প্রায় ২৫ হাজার দর্শক ভিড় করেছিল। তাদের বড় অংশই যে ওয়ার্নারকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। গ্যালারিতে ছিলেন ওয়ার্নারের বাবা-মা, স্ত্রী ক্যান্ডিস ও তার তিন মেয়েও। তাদের কথা বলতে গিয়ে আরেকবার আবেগ ছুঁয়ে গেল ওয়ার্নারকে। “(পরিবার) আমার জীবনের বিশাল অংশজুড়ে আছে এবং তাদের সহায়তা ছাড়া কিছু করা যায় না। আমাকে খুব চমৎকার ও দারুণভাবে গড়ে তোলার কৃতিত্ব বাবা-মায়ের। আমার ভাই স্টিভ, ওর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি আমি..।” “এরপর ক্যান্ডিস এলো জীবনে এবং আমাকে একরকম পথে ফেরাল। দারুণ একটি পরিবার আমাদের এবং ওদের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত আমি লালন করি যতেœ। জীবন দিয়ে ভালোবাসি ওদেরৃ আর বলতে চাই না, কারণ আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি। তবে ‘ধন্যবাদ ক্যান্ডিস, যা কিছু করেছো, সবকিছুর জন্য। আমার জন্য তুমিই গোটা দুনিয়া এবং আমি কৃতজ্ঞ।” কদিন পরই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজ। সেখানে থাকবেন না ওয়ার্নার। হয়তো তাকে দেখতে হবে গ্যালারি থেকে বা চোখ রাখতে হবে টিভি পর্দায়। মাঠে না থাকার ধাক্কা তখন আরও জোরালভাবে অনুভব পাবেন তিনি। তবে দলকে শুভ কামনাও জানিয়ে রাখছেন। “ছেলেদেরকে মাঠে দেখাটা এবং নিজের খেলতে না পারাটা বেশ আবেগময় ব্যাপার হবে। মনে হবে, আমিও থাকতে পারতাম ও যা করতে পারি, তা করতে পারতাম। তবে দারুণ এক দল ক্রিকেটার আছে আমাদের। আমাদের প্রায় সবারই বয়স তিরিশের বেশি, সময়ের সঙ্গে কারও বয়স কমছে না। তবে এই দলটা প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও বিশ্বমানের, এই ছেলেরা দারুণ।” টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসেও ব্যাট হাতে দেখা গেছে সেই চেনা ওয়ার্নারকে। আগ্রাসী সব শট, সুইপণ্ডরিভার্স সুইপ, দাপুটে পুল, সবই দেখা গেছে। নিজের রূপে থেকেই বিদায় নিতে পারা তাকে বাড়তি তৃপ্তি দিচ্ছে। “আমরা বিনোদনের জগতের মানুষ এবং আমি খুবই খুশি যে মাঠে নেমে সেটিই করতে পেরেছি, সবসময় যা করি। টি-টোয়েন্টি দিয়ে শুরু করেছিলাম, এরপর এখানে (টেস্টে) এসেও সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি, সব শট খেলেছি, যেভাবে খেলতে পছন্দ করি, সেভাবেই খেলেছি।” প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের আগেই ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তার অভিষেক টি-টোয়েন্টি দিয়ে। অভিষেকে ৪৩ বলে ৮৯ রানের ইনিংস খেলার পর তার পরিচয় হয়ে গিয়েছিল টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান। কিন্তু বিধ্বংসী সেই টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান ক্রমে লাল বলের ক্রিকেটেও মানিয়ে নিলেন দারুণভাবে। টেস্টেও আলো ছড়ালেন প্রবলভাবে। সেই তিনি এখন ক্যারিয়ার শেষ করলেন ১১২ টেস্ট খেলে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি টেস্ট কেউ খেলেনি, এত রান কেউ করেননি। সব দেশ মিলিয়েই টেস্ট ইতিহাসের চতুর্থ সফলতম ওপেনার তিনি। নিজের মতো খেলেই ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন, আড়াইশ পেরিয়েছেন আরেক দফায়। ম্যাচে জোড়া সেঞ্চুরি করেছেন রেকর্ড তিনবার। এই সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারের শেষ দিনটিতে অবধারিত প্রশ্নটিও এলো, লোকের কাছে কিভাবে স্মরণীয় থাকতে চান ওয়ার্নার? তার উত্তরে মিশে থাকল তার ক্রিকেট দর্শনই। “(স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই) রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদায়ী একজন হিসেবে এবং আশা করি, যেভাবে খেলেছি, তাতে সবার মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। আশা করি, বাচ্চারা ও উঠতিরা আমার পথ অনুসরণ করবে। সাদা বলের ক্রিকেট থেকে টেস্ট ক্রিকেটে এসে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেৃ এটিই খেলাটির চূড়া। কাজেই পরিশ্রম করে যাও লাল বলের ক্রিকেট খেলতে, কারণ এটিও বিনোদনদায়ী।” “সবসময় অকৃত্রিম থাকার চেষ্টা করেছি, কখনোই বদলাইনি। সবসময়ই বলেছি এবং এখনও বলব। এটিই আমি বিশ্বাস করি, নিজের প্রতি সৎ থাকা। টেস্ট ক্রিকেটেও আমি সাহসী ও নির্ভীক থেকেছি। নিজের ধরনেই খেলেছি এবং দাপট দেখাতে চেয়েছি। এমন একজন হিসেবেই মনে থাকতে চাই, যে খেলাটাকে এগিয়ে নিত, প্রবল গর্বিত ও অনুরাগী একজন, চেষ্টার কোনো কমতি যে রাখেনি।”