এক সময়ের খরস্রােতা শিবসা নদী ভরাট হয়ে সমতল ভূমি আর শুধুই স্মৃতি। তীব্র নাব্য সংকটে এ নদীতে এখন আর নৌকা দেখা যায় না। টিআরএম পদ্ধতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী শিবসা ও হাড়িয়া নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবীতে অবাবহিকার মানুষ সোচ্চার হয়েছে। গত ২৫ জানুয়ারি উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণের সার্বিক সহযোগিতায় পৌর বাজার সংলগ্ন শিবসা নদীর বুকে ব্যতিক্রমী এক আলোচনার আয়োজন করে উপজেলা পানি কমিটি। সভায় বক্তারা বলেন, শিববাটী ব্রিজ সংলগ্ন কপোতাক্ষ প্রান্ত থেকে সোলাদানা খেয়াঘাট পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার নদী পলি জমে ভরাট হয়ে মরাখালে পরিণত হয়েছে। যার ফলে নৌযান চলাচল ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি নদীর বুকে জেগে ওঠা চর দখল করে নিচ্ছে কতিপয় মহল ও ব্যক্তিরা। ঐতিহ্যবাহী এ দুটি নদী দখল মুক্ত করে টিআরএম বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক নাব্যতা ফিরিয়ে আনার দাবী জানান কমিটির নেতৃবৃন্দ। উল্লেখ্য মানুষ দুর্গম এলাকায় নৌকার পরিবর্তে এখন পায়ে হেঁটে চলাচল করেন। জানা গেছে, খুলনার পাইকগাছা, দাকোপ এবং কয়রা উপজেলার মাঝে অবস্থিত শিবসা নদী। প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ শিবসা নদীর দুই পাড়ে বসবাস করছেন। জেগে ওঠা চর দখলে পাইকগাছা অংশে রীতিমত শুরু হয়েছে প্রতিযোগীতা। স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমি দস্যুরা যে যার মত গিলে খাচ্ছে শিবসা নদীর জেগে ওঠা জমির অংশ বিশেষ। শিবসা নদী এখন সমতল ভূমি। বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের পথ। নদী খননের জন্য নেই কোনো উদ্যোগও। সারাদেশে নদীর দখল ও দূষণ ঠেকাতে সরকার যে মূহুর্তে অভিযান শুরু করেছে, ঠিক সেই মূহুর্তে শিবসা নদী দখল প্রক্রিয়াকে ভাল চোখে দেখছেন না শান্তিপ্রিয় শান্ত এ জনপদের সাধারন মানুষের পাশাপাশি পরিবেশবিদরা। তারা দখল ঠেকাতে ও নদী খননে সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পাইকগাছা পৌরসভা ছাড়াও উপজেলার গদাইপুর, লতা, সোলাদানা, দেলুটি, লস্কর ও গড়ইখালী ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শিবসা নদী। শিবসা নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৮৫ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৫১০ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক শিবসা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৮৮। নদীটি উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের প্রবাহমান কপোতাক্ষ নদ হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অত:পর এই নদীর জলধারা একই জেলার দাকোপ উপজেলার খুলনা রেঞ্জ এলাকায় প্রবাহমান পশুর নদীতে নিপতিত হয়েছে। গত কয়েক বছর আগেও নদীতে সারাবছর নৌযান চলাচল করতো। জোয়ার ভাটার প্রভাবে প্রভাবিত হতো। এই নদীর কিছু অংশ বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল রুটের অন্তর্গত। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথ হিসাবে স্বীকৃত। শিবসা নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার ভরাট হয়ে গেছে। অনেকে নদীর জায়গায় বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করছেন। যে কারণে দিন দিন নদীর জায়গা কমছে। নদীর বক্ষে পলি পড়ে সমতল ভূমি হয়েছে। এ ছাড়া নদীর জমি দখল করে চিংড়ি ঘের করেছে অনেক প্রভাবশালীরা। এলাকার সামসুর মাঝি জানান, ৪০ বছর ধরে খুলনা থেকে নৌকায় করে মালামাল নিয়ে নৌপথে পাইকগাছা পৌরসভা বাজারে নিয়ে আসছি। নদীর অনেক স্থানে ভরাট হওয়ায় এখন আর নৌকা চলে না। নৌপথ বন্ধ হওয়ায় নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পাইকগাছা নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাড. প্রশান্ত মন্ডল বলেন, গত এক যুগে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। নৌপথ দিয়ে মালামাল সরবরাহ করতে না পারায় এখন পৌরসভা, গড়ইখালী ও নতুনবাজার পাইকারি হাট প্রায় বন্ধের পথে। নদীটি খননের জোর দাবী জানান তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাইকগাছা শাখা কর্মকর্তা (এসও) রাজু আহম্মদ জানান, নদী খননের জন্য জরিপ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। পৌর মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর বলেন, পাইকগাছাবাসীর একটাই দাবি শিবসা নদী খনন। যার কোনো বিকল্প নেই। পাইকগাছা উপজেলা সহকারি কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান বলেন, নদীর জায়গা দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে সরকারি জায়গা দখলের অপরাধে ৬ ব্যক্তিকে ৭ দিন করে কারাদণ্ড দেন তিনি। সুন্দরবন উপকূলীয় শিবসা নদীর মৃত্যু হলে কপোতাক্ষ নদসহ সংযুক্ত কয়েকটি নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এতে করে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে আটকে উপকূলীয় যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার কয়েক লক্ষ মানুষ কৃত্রিম বন্যায় প্লাবিত হতে পারে। আর শিবসা নদী হবে কালের স্মৃতি।