“নারী তুমি
অন্ধের দৃষ্টি, বোবার ভাষা, বোধির শোনার অভিলাষ
প্রাণের আকুতি, মনের মিনতী, সৃষ্টির মহা ইতিহাস
তুমি বেহুলার ভেলা, আনন্দ মেলা, তুমি স্বর্গের অপ্সরী
প্রিয়সী আমি, পিপাসার্থ মন, তোমার প্রতীক্ষায় মরি... ”
কবির ভাষার বিভিন্ন চ্যোতনায় ফুটে উঠে নারীর বহুমুখী রুপ। নারী সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য সৃষ্টি। সে একাধারে মমতাময়ী মা, দরদী বোন, যত্নশীল স্ত্রী, পিপাসু প্রেমিকা আবার অন্যেিক ায়িত্বশীল কর্মজীবী, শ্রমজীবী, ব্যবসায়ী; কখনো কখনো এই নারীই আবার যোদ্ধা, বীর সৈনিক। বাংলােেশর ইতিহাসে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন একটি ঐতিহ্যবাহী পটভূমির নাম। আর এই ইতিহাসের সোনালী বুননে লেখা একটি নাম মমতাজ বেগম।
ভাষা সংগ্রামী মমতাজ বেগম নামটি শুনলে একদিকে যেমন শ্রদ্ধায় অবনত হয় আমাদের মাথা; তেমনি দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে উঠে আমাদের হৃদয়। কেননা এই মমতাজ বেগম প্রেমের টানে যেমন ছেড়েছেন তাঁর পরিবার, ধর্ম এমনকি দেশ; আবার সেই প্রেম তুচ্ছ হয়ে গেছে ভাষা, দেশ আর আন্দোলনের টানে।
সংগ্রামী সৈনিক মমতাজ বেগমের প্রকৃত নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। তাঁর ডাক নাম ছিলো মিনু। যদিও মিনুর পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজশাহীর রঘুন›পুরের জমিদার তথাপি তিনি ১৯২৩ সালের ২০ মে কলকাতার হাওড়া জেলার শিবপুরে সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায় এবং মাতা মাখন মতি দেবী ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। কিন্তু মিনুর সম্ভ্রান্ত অথচ রক্ষণশীল পরিবার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাননি। ১৯৩৮ সালে নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় প্রাইভেটে পড়ে মিনু মেট্রিক পাস করেন। এরপরই পরিবার থেকে পড়াশোনার ছেড়ে দেয়ার চাপ আসতে শুরু করে। অন্যেিক উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে মিনু ছিলেন ভীষণ অধ্যবসায়ী। অনড় মিনুর কাছে হার মেনে নিল বিচারপতির রাঙিয়ে ওঠা চোখ। মামার সহযোগিতায় কঠিন পর্দাপ্রথার মধ্যে থেকেও ১৩৪২ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এবং কলকাতার দি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ায় যোগদান করেন। এই ব্যাংকে লেনেেনর সূত্র ধরেই মিনুর জীবনের নতুন লেনেেনর শুরু হয়। কলকাতা সিভিল সাপ্লাই অফিসের কর্মকর্তা আবদুল মান্নাফ একই ব্যাংকের গ্রাহক ছিলেন। অফিসের কাজে তার একাউন্টে প্রচুর টাকা লেননে করতে হতো। এভাবেই পরিচয় ঘটে স্নিগ্ধ হাসির অধিকারী কল্যাণী রায় চৌধুরী মিনুর সাথে। ধীরে ধীরে সেই পরিচয় পরিণত হয় পরিণয়ে। বাঁধ সাধে মিনুর রক্ষণশীল বাবা রায় বাহাদুর মহিম চন্দ্র রায়। শুধু চাকরিই নয়; মেয়ের বাড়ির বাইরে বের হওয়াই বন্ধ করে দেন। কিন্তু প্রেম মানে না কোন বাধন, কোন বাধা। একরোখা মিনু মান্নাফের প্রেমজ স্বপ্নে বিভোর হয়ে ত্যাগ করলেন পরিবার-পরিজন। এমনকি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। কল্যাণী রায় চৌধুরী মিনু থেকে হয়ে গেলেন মমতাজ বেগম। অতঃপর মান্নাফ সাহেবকে বিয়ে করে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশবিভাগের পরে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন ময়মনসিংহে। থাকতে শুরু করেন মান্নাফের রেল কর্মকর্তা বাবার ময়মনসিংহ রেল করোনীর বাসায়। এখানকার ব্যিাময়ী স্কুলে সাত মাস সহকারী শিক্ষিকার ায়িত্ব পালনের পর ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ১৩৫১ সালে বিএড পরীক্ষায় পাস করেন। তারপর নারায়ণগঞ্জের মর্গান স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে শুরু করেন নতুন জীবন।
১৯৫২ সাল। চারিদিক তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার াবীতে উত্তাল। ব্যতিক্রম ছিল না নারায়ণগঞ্জও। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে অনশন শুরু করলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠে। অতঃপর অবস্থা বেগতিক েেখ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে খুবই গোপনে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন ঢাকা েেক ফরিদপুওে যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল স্টিমার যা নারায়ণগঞ্জ েেকই ছাড়তো। তখন সুযোগ বুঝে বঙ্গবন্ধু নারায়ণগঞ্জের নেতা-কর্মীরে তাদের বাংলা ভাষার দাবীতে অনশনের কথা জানিয়ে কঠোর কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়ে দেন। বিক্ষুব্ধ জনতা সারােেশ সভা-সমাবেশের উপর চলমান নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিশাল বিশাল মিছিল বের করে। এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্মম গুলি বর্ষণে অগণিত ছাত্র-ছাত্রী-সাধারণ জনগণ আহত ও নিহত হন। মমতাজ বেগম তখন নারায়ণগঞ্জ জেলার মর্গান হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। (ঠিকানা : শান্তা ফারজানা, প্রতিষ্ঠাতা, সাউন্ডবাংলা স্কুল)