পান-সুপারি দিয়ে আতিথেয়তা ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ এলাকার পুরোনো সংস্কৃতি। ভাওয়াইয়ার সুর সমৃত জনপদে বছরের পর বছর ধরে মেহমানদারিতে রাখা হচ্ছে পান-সুপারি। এ যেন এ এলাকার মানুষের আতিথেয়তার ঐতিহ্য। এ কারণে ধানের দেশে পানের কদর কমেনি,বরং পানের চাষ বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এতে করে ধান,পাট,তামাকের পাশাপাশি কালীগঞ্জ অঞ্চলের পান এখন অর্থকরী ফসলের অংশ হয়েছে। প্রতি বছর পানে হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। সেই সঙ্গে পরিত্যক্ত জমি পান চাষের আওতায় আসায় কৃষকের আয়ও বেড়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলায় অনেকে অন্যান্ন ফসল চাষ না করে পান চাষ বানিজ্যিক ভাবে চাষ করছে। একসময় এলাকার অনেকেই জীবন যুদ্ধে লেগেছিল অভাব-অনটন, সংসারে দুঃখ ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তখন কষ্ট দূর করতে স্বল্প পুঁজিতে পান চাষে মনোনিবেশ করেছে অনেকেই। তাদের ভাগ্যে ধৈর্য আর পরিশ্রমে বদলে যেতে থাকে তাদের জীবন। পানের ব্যাপক ফলনে সে সব পরিবারের জীবনে নেমে আসা দরিদ্রতার কারণে হন নিরুদ্দেশ। পানের বরজে ভাগ্যের চাকা ঘুরে হাসি ফুটে উঠেছে পরিবারে। এলাকার অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে পান চাষ করে, ফলে বলা যায় তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরে দাড়িয়েছে।দিন বদলের হাওয়ায় পান চাষে বদলে গেছে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার মানুষের জীবনচিত্র। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জের পৌর এলাকা থেকে শুরু করে শহর তলীর গ্রাম গুলোতে রয়েছে পান চাষের ব্যাপকতা। বিশেষ করে দুলালমুন্দিয়া, রায়গ্রাম, শালিখা, বলরামপুর, জামাল, কোলাবাজার, চাপরাইল, গোপালপুর, বারোপাখিয়া, বালয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন গুলোতে প্রায় চাষাবাদের এক চতুর্থাংশ জুড়েই এ পানের বরজ ও পানের এই চাষাবাদটাও দীর্ঘ মেয়াদী। সারাটা বছর জুড়েই ব্যাস্ত থাকতে হয় এ এলাকার পান চাষিদের। এই পান যাচ্ছে ঢাকা,খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। অনেক সময় এ অঞ্চলের পান দেশের বাইরে যাচ্ছে, বলে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কালীগঞ্জের গ্রাম গুলোতে অনেক ভালো মানের পানের চাষ হয়, এ কারণে রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। ফলে মিঠা, উজানি, কর্পুরি পানের চাহিদা অনেকটাই বেশি। চাষিরা এখন জৈব সারের পাশাপাশি ব্যবহার করছেন টিএসপি, এমওপি, ইউরিয়া, এসএমপি। বৈজ্ঞানিক ভাবে চাষাবাদের কারণে ফলনও পাচ্ছে বেশি। পানের বরজে গেলে কথা হয় পান চাষি শ্যামলের সাথে। বলরামপুর মাঠে তার ৩ দাগের দুই বিঘা জমিতে পানের চাষ আছে।পার্শবর্তী দাগে বরজ আছে তাপস সরকারের তিনি জানান, নতুন করে একটি বরজ করতে গেলে এক বিঘা জমিতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকার। জমি তৈরির পাশাপাশি এর উপকরণ গুলো বেশ ব্যায় বহুল ও পান বরজে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এই বরজটির বেস্টুনি দিতে লাগে বাশ, খড়, চটা,পাটকাঠি ও তার, বরজ গুলোতে অনেক সময় বেড়ায় ব্যবহার করা হয় কলাগাছের পাতা। জমি তৈরিতে প্রয়োজনে উঁচু বন্যার পানি মুক্ত বেলে দোঁআশ ও এঁটেল দোঁআশ মাটি। বরজের ভিতরে থাকতে হবে নাতিশীতষ্ণ আবহাওয়ার ইমেজ। আর পানের লতা থেকেই পানের গাছ হয়। মাটি চাষের পর এই লতা গুলো ৪৫ ডিগ্রী এঙ্গেলে পুতে দিতে হয়, প্রতি শতকে ৩ থেকে ৬ ইঞ্চি পানের কাটিং লাগে ৪৫০ থেকে ৫০০ পিচ। বরজের ভিতরে ২ ফিট চওড়া রাস্তা ও রাখতে হয়। প্রতিটি পানের বেড তৈরি করতে হয় ৪ থেকে ৪.৫ ফিট। একটি লাইন থেকে আরেকটি লাইনের দুরত্ব ১২ ইঞ্চি থেকে ১৬ ইঞ্চি। জমিতে পান লাগানো হয়ে গেলে প্রতিনিয়ত ঝাঝরার মাধ্যমে দিতে হয় পানি সেচ। এখানে ভাল জাতের পানের জন্য সুষম সার ব্যবস্থপনাও জরুরি বলে পান চাষিরা মনে করেন। পানের মান ভাল হলে ১ বছর পর থেকে পান তোলা যায়। প্রতি বিঘায় পান ওঠে ৪ ডোল করে যার বাজার মূল্য ৮০ থেকে ১ লক্ষ টাকা। আবার অনেক সময় পানের দাম কম হয়ে থাকে তখন চাষিরা খরচের টাকা তুলতে হিমসিম খেয়ে থাকে। প্রতি বছর একাধিকবার বরজ থেকে পান তোলা হয়। পান চাষিরা বলছেন বাজারে দাম ভাল থাকলে প্রতি বছর সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বছরে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা লাভ করা যায়।পান চাষ দেখে বর্তমানে ওই এলাকার চাষিরা পান চাষ করছেন। এই উপজেলার ১১ ইউনিয়নে ও একটি পৌরসভার মধ্যে সাধারণ চাষিরা অন্যান্য চাষাবাদের সঙ্গে পান চাষ করছে। উৎপাদন খরচ বেশি হলেও বছরের অধিকাংশ সময়ই পানের দাম ভালো পাওয়া যায়। তাই অন্যান্য ফসলের সঙ্গে চাষিরা পান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কালীগঞ্জ উপজেলায় দেশ স্বাধীনের পর থেকে অনেকেই বানিজ্যিক ভাবে এ পান চাষ করে থাকে।সারা বছর পান পাতা বিক্রি করে আয় হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। তাদের মতে বরজে পান আছে মানে টাকার সংস্থান তৈরি হয়ে আছে।আবার পান বরজ আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে থাকে। প্রচন্ড গরম, ভাইরাস, ঝড়-বৃষ্টির পানিতে ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে চিন্তায় থাকতে হয়। কিন্তু পানের দাম সারা বছরই ভালো থাকে। এখানে ঝুঁকি ও খাটুনি কম কিন্তু আয় বেশি। চার মাস পরিশ্রম করার পর একবার ধান, পাট, আলু ঘরে তোলা যায়। অপরদিকে বরজের পানপাতা সারা বছরই বিক্রি করে টাকা আসে। একবার পানের বরজ গড়ে তোলা হলে তা প্রায় এক যুগ ধরে টিকে থাকে। ফলে একবার পানে বিনিয়োগ করলে এক যুগ ধরে এর ফসল ভোগ করা যায়। চাষিরা জানান, পান গাছ লাগানোর ছয় মাসের পর থেকেই ফলন পাওয়া যায়। আর একবার লাগানো গাছ থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর অনায়াসে সংগ্রহ করা যায় পান পাতা। ধানসহ অন্যান্য ফসলের তুলনায় পান চাষে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে পানের বাম্পার ফলন হয়। আর ফলন ভালো হলে বাজারে দাম ভালো পাওয়া যায়। এলাকার পান বরজের চাষিরা বলছে, সরকারি সহায়তা ও স্বল্পসুদে ঋণ পেলে আগামীতে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলায় পানের চাষ আরও বাড়বে। বর্তমানে পান চাষিরা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পান সরবরাহ করছে বলে জানান।শালিখা গ্রামের হোসেন আলী জানান, ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে পানের ফলন ভাল হয়। তাদের এই আধুনিক পদ্ধতির পানের চাষাবাদে তারা এখন বেশ লাভবান হচ্ছেন। এই পান নিয়ে আসতে হয় শহরের বাজারে। কালীগঞ্জ ঝিনাইদহ মহাসড়কের নিমতলা ব্রীজের পাশে, বলরামপুর বাজার, সিংগি বাজার, চাপরাইল বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে গড়ে উঠেছে বিশাল পানের হাট। সপ্তাহে ২ দিন প্রতিটি হাটবসতে শুরু করে সূর্য ওঠার অনেক আগেই। অল্প সময়েই হয়ে যায় পাইকারি বিক্রি। পানের যথেষ্ঠ চাহিদা থাকায় এই পান বিক্রি করে হাসি মুখেয় ফিরে যান পান চাষিরা। বহুকাল ধরে সুনাম ধরে রেখেছেন কালীগঞ্জের পান চাষিরা। তদের সময়ের দাবি যথাযোগ্য সংরক্ষণ এবং বিদেশে রপ্তানি করে এ চাষাবাদের আরও সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করে চাষিরা।