মৃৎশিল্প আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দেশের অন্যতম প্রাচীন শিল্প হচ্ছে মৃৎীশল্প মৃৎশিল্প। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক অনেক গভীর। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলতে এখানে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে দিয়ে তৈরি সব শিল্পকর্মকেই মৃৎশিল্প বলা যায়। একসময়ে মেলা মানেই ছিল মাটির তৈরি বিভিন্ন জিনিস পত্রের বিচিত্র সমাহার। শিশুদের খেলার রংবেরঙের মাটির পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল,কড়াই,পালকি,পাখি, টমটম গাড়ি,ব্যাংকসহ আরও কত কি পাওয়া যেতে মেলায়। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। আজকাল কুমারপাড়ার নারী-পুরুষেরা ব্যস্ত সময় পার করেন না। কাঁচা মাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায় না সেখানে। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসে না ঠিকমত। তবে নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো কিছু কুমার পরিবার ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার এই ঐতিহ্য। এই ধরনের কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কুমার বলা হয়। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেক বেশি। গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হতো মাটির জিনিসপত্র। রান্নার হাঁড়ি-পাতিল,কলসি,খাবারের সানকি,মটকি,সরা ইত্যাদি। বাঙালির সংস্কৃতির এক অবিচ্ছিন্ন অংশ মৃৎশিল্প। চলতি শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত কুমার আর পালদের গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মৃৎশিল্প।আর মৃৎশিল্পের ব্যবহার বলতেও বাসন কোসন, হাঁড়ি আর কলসিকেই বোঝাত। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক হিসেবে বিশ্ববাসী দেখছে এ নিদর্শন। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে কুমার আর পালদের গন্ডি ডিঙিয়ে সর্বজনীন রূপ পেয়েছে মৃৎশিল্প। নতুন নতুন উদ্যোক্তারা মৃৎশিল্পে জড়িয়ে ব্যবসা শুরু করছেন। নানা নকশা আর কারুকাজে প্রসারিত হয়েছে মাটির পাত্রের ব্যবহার। মাটির তৈরি জিনিসপত্র এখন প্রধান তৈজসপত্রে ও সৌন্দর্যবর্ধনের উপকরণে পরিণত হয়েছে। এ শিল্পে এখন অনেকটা বেড়েছে বিনিয়োগ। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার চিত্রা নদীর তীরবর্তী দোঁ-আশা মাটির সহজলভ্যতা এবং পরিবহনের সুবিধার্থে এ শিল্প গুলো গড়ে ওঠেছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এই পেশায় নিয়োজিত পাল পরিবারের ২০ থেকে ৩০টি পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের এই পেশাকে আকড়ে ধরে বাচার চেষ্টা করছে। শিবনগরে দিপালি পাল, নিশ্চন্তপুরের জীবন পাল, অনুপম পুরের সৌরভরা এখনো কোনো মতে এই পেশা চালিয়ে যাচ্ছে।পরিবেশ বান্ধব এ শিল্প শোভাপেত গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। এ শিল্পের প্রধান উপকরণ এঁটেল মাটি, জ¦ালানি কাঠ, শুকনো ঘাস, পানি,বাশর পাতা, খড় ও বালি। ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের শিবনগর পালপাড়ার এক ব্যাক্তি বলেন, লেখাপড়া তেমন শিখেননি, ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে মাটির এসব জিনিসপত্র বানানো শিখেছেন। এখন সময় খারাপ, তেমন বিক্রি হয় না, তবুও বিভিন্ন বাজারে বাজারে জিনিসপত্র নিয়ে বসেন, ক্রেতার আশায়। একসময় ব্যস্ত সময় পার করতেন আর এখন চাহিদা নেই বললেই চলে। আগে সারা বছরই মাটির জিনিস পত্র তৈরি করতেন, তবে বৈশাখকে সামনে রেখে চৈত্রের শুরু থেকে কাজ বেড়ে যেতো। কালীগঞ্জ উপজেলার শহরে ও বিভিন্ন গ্রামের বাজারে একসময় বৈশাখী মেলা বসতো, মেলায় মাটিরবিভিন্ন খেলনা ও পরিবারের সংসারে প্রযোজনীয় হাড়ি পাতিল তৈরি করতো মেলায় বিক্রির আশায়। যে কারণে তখন দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করতেন মেলায় তাদের জিনিস বিক্রি করতে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আড়ং এবং মেলায় এই ধরণের সামগ্রীর চাহিদা ছিল ব্যাপক। মেলা থেকে মাটির খেলনা কিনেনি এমন মানুষ পাওয়াই কষ্ট। ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা মূল্যের জিনিষ পত্র পাওয়া যেত। হারিয়ে যাচ্ছে কালীগঞ্জের এই মৃৎশিল্পের ঐতিহ্যময় কারুকার্জ। আধুনিক প্রযুক্তিতে নিম্ন মানের তৈরি প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, মেলামাইন ও স্টিলের জিনিসপত্র তৈরির আকার বেড়ে যাওয়াই এই শিল্প আজ প্রায় ধংসের পথে। কালীগঞ্জের শিবনগর,সিংগি,রায়গ্রাম,জটারপাড়া, নিশ্চন্তপুর,অনুপমপুর এই এলাকা গুলোতে পাল বংশের লোকের বসবাস ছিল বেশি। মৃৎশিল্পের তৈজসপত্র বিক্রেতা হাসিবুল হাসান জানান, মৃৎশিল্পের তৈরি ব্যাবহার্য পন্যের এখন আর তেমন চাহিদা বাজারে নেই। সেীখিনতার বসে কেউ যদি কিছু ক্রয় করলে সেটাই তার বিক্রি। মৃৎশিল্পে কাজ করা ব্যক্তিরা জানান, তাদের সন্তানাদি কেউ আর এই পেশায় কাজ করতে আগ্রহী নন। বর্তমানে এই পেশায় কাজ করা ব্যক্তিরাই শেষ প্রজন্ম। লোকজ এই মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রখার জন্য সরকারি সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতায় বাচিয়ে রাখা সম্ভব।গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমার এবং পালদের সহজ শর্তে ঋণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখা জরুরি। পরিবেশবান্ধব এই শিল্পকে বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য। লাগামহীন দ্রব্যমুল্য ও আধুনিকতার আগ্রাসনের কারণে মৃৎ শিল্পের তৈজসপত্র তৈরিতে বেড়েছে খরচ আর কমেছে দাম। এছাড়াও চায়নাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র দেশে আশায় প্রতিযোগিতায় টেকা দায় হয়েছে তাদের। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই পেশা বদলাতে চাইছেন এ সম্প্রদায়ের কারিগরেরা। এতে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ অঞ্চলের মৃত শিল্প।মৃৎ শিল্পীদের ভাষ্য, এই ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। সমবায় সমিতি কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে সহজ শর্তে লোন পাচ্ছেন না তারা। আবার ভারত ও চায়না থেকে মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র দেশে আশায় প্রতিযোগিতায় টেকা দায় হয়েছে তাদের। কারণ, চায়না ও ভারতের তৈরি জিনিস গুলো দেখতেও যেমন সুন্দর আবার দেশি তৈজসের চাইতেও অনেক মজবুত। এসব তৈজসপত্র তারা তৈরি করে অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে। যার দাম অনেক বেশি। মৃৎ শিল্পীদের দাবি সরকারি সহায়তায় যদি মৃত শিল্প বাঁচাতে প্রশিক্ষন ও প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হয় তবে দেশেও ঝুঁকির মধ্যে থাকা মৃত শিল্প বাঁচিয়ে উন্নতমানের তৈজসপত্র তৈরি ও সরবরাহ করা সম্ভব। একসময় পাল সম্প্রদায়ের হাতের তৈরি মাটির তৈজসপত্রের কদর ছিল বেশ। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে পালদের তৈরি তৈজসপত্র। এখন আনুধিক যুগে কাঁচ, সিলভার, অ্যালুমিনিয়াম, প্ল্যাস্টিক, সিরামিক অথবা মেলামাইনের তৈজসপত্র বাজারে ভরপুর থাকায় মাটির তৈরি জিনিসপত্র হারাতে বসেছে। শুধু আধুনিক তৈজসপত্রই বিলুপ্তি বা ঝুঁকির কারণ নয়। ঝুঁকির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে মাটির সংগ্রহ ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি মাটির সংগ্রহ করতে লেবার খরচ দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা গুনতে হয়। এছাড়াও পরিবহনে লাগে খরচ। শিবনগর পালপাড়া গ্রামের মৃৎ শিল্পীরা জানান, এখনো শহর কিংবা গ্রাম এখনো মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই, ডাবর-মটকি, মাটির ব্যাংক, গহনা, কলস, ফুলের টব, ফুলদানি, ঢাকনা, পিঠা তৈরির ছাঁচসহ নানা ধরনের খেলনার চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে দই-মিষ্টির হাড়ি, ফুলদানি, ফুলের টব,কড়াইসহ টুকিটাকি তৈজসপত্রের চাহিদা প্রচুর। শহরে এসব আসবাবের ক্রেতাও রয়েছে প্রচুর।প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে অনেকেই বলেন, ভালো এঁটেল মাটি এখন আর সহজে পাওয়া যায় না। এঁটেল মাটি না মেলায় মাটির জিনিস টেকসই হয় না। তাই ভালো মাটি দূরদূরান্ত থেকে সংগ্রহ করতে গেলে চড়া মূল্য গুনতে হচ্ছে। এক ট্রাক্টর মাটির মূল্য পড়ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। এক ট্রাক্টর মাটি দিয়ে যে হাঁড়ি-পাতিল তৈরি হয়, তাতে কোনো রকমে পয়সা উঠে। অনেক সময় মাটি ভালো না হলে লোকসানও গুনতে হয়।মৃত শিল্পীরা বলেন,অভাব অনটনের মধ্যেও হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছে।