আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর-অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। না অর্ধেক নয় তারও বেশি করেছেন একজন নারী কর্মকর্তা। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন যশোরের চৌগাছা উপজেলার সদ্য বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। যশোরের খেজুর গুড়ের জিআই স্বীকৃতি নিতে ইরুফা সুলতানা যা করেছেন তা যশোরবাসী মনে রাখবে যুগযুগ ধরে। এক তথ্যানুসন্ধানে জানাযায় ২০০৩ সালে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য অনুমোদনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পেটেন্ট,ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে একে পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) নামে অভিহিত করা হয। শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের ফলে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য ( নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন -২০১৩ পাশ হয়। এর দুই বছর পর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য বিধিমালা ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৬ সালে জামদানী শাড়িকে প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর কেটে গেছে আট বছর। একে একে পার হয়ে গেছে অনেক জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিন্তু কারো মনে পড়েনি খেজুর গুড়ের কথা। বৃটিশ কোম্পানিগুলো খেজুর গুড় চিনলেও আমরা বাঙালি হয়েও খেজুর গুড়কে চিনতে পারিনি। অবশেষে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর চৌগাছা উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন ইরুফা সুলতানা। যোগদান করেই তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা সামাজিক কর্মকান্ডে। নানারকম সামাজিক কার্যক্রম সম্পাদন করে চৌগাছাবাসির মনের মনিকোঠায় স্থান করে নেন তিনি। এলাকার উন্নয়নেও নানাবিধ কর্মকা- পরিচালিত করতে থাকেন। একপর্যায়ে তার নজর পড়ে যশোরের ঐতিহ্য খেজুর গুড়ের ওপর। যেই চিন্তা সেই কাজ যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খানের সহযোগিতায় বেলন বিলের মাঠে অবৈধভাবে দখলে রাখা সরকারি জমি উদ্ধার করে সেখানে রোপন করেন শতশত খেজুর গাছের চারা। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করেন চৌগাছার বিশিষ্ট সাংবাদিক আজিজুর রহমান,সিংহঝুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ মল্লিক, স্বরুপদাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল কদর,ধুলিয়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম মমিনুর রহমানসহ চেয়ারম্যানগন ও রোভার স্কাউট লিডার ফিরোজ হুসাইন। এ ছাড়া সরকারি রাস্তার পাশে, কপোতাক্ষ ও ভৈরব নদীর পাড়ে খেজুর গাছের বীজ রোপন করেন। অনেকে তার এসব কার্যকলাপ নিয়ে হাস্যরসিকতা করলেও থেমে যাননি তিনি। খেজুর বীজ রোপন শেষ করেই লেগে যান খেজুর গাছ কাটা গাছিদের ডেটাবেইজ তৈরীর কাজে, ডেটাবেইজ সম্পন্ন করেই গাছিদের নিয়ে করেন সমাবেশ। গাছি সমাবেশে যোগদান করে গাছিরা আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়েন,গাছিরা বলেন তাদের খবর কেউ রাখেনি আজ তাদের জীবন ধন্য, তারা বলেন আমরা কিছুই চাই না আমাদের ডেকেছেন এতেই আমরা খুশি। অনেকে ইরুফাকে মা বলে সম্বোধন করেন। ইরুফা তাদের হাতে তুলে দেন শীতবস্ত্র এবং নগদ প্রণোদনা। এক কাজে তার পাশে থাকেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসাব্বির হুসাইন। ইরুফা সুলতানার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা করে যান জেলা প্রসাশক তমিজুল ইসলাম খান। এরপর ২০২২ সালের মাঘ মাসে ইরুফা বাস্তবায়ন করেন এক ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ। যার নাম খেজুর গুড়ের মেলা। নেট দুনিয়ার মাধ্যমে সাড়া পড়ে যায় যশোর জেলাসহ সারাদেশ ব্যাপী।গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রবাসীরাও খবর পেয়ে আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়েন। প্রশংসার বন্যায় ভাসতে থাকেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। এরপরেই শুরু সেই কাক্সিক্ষত জিআই সনদ পাওয়ার প্রচেষ্টা। নিয়মানুযায়ী জেলা প্রশাসককে আবেদন করার বিধান থাকলেও অত্যান্ত উদার মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান ইরুফা সুলতানাকে আবেদন করতে বলেন। তার সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৫ ফেব্রুয়ারী খেজুর গুড়কে জিআই স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। খেজুর গুড় নিয়ে আগ্রহের কারণ এবং খেজুর গুড়ের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর কেমন লাগছে প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় ইরুফা সুলতানা বলেন, আমি বাংলাদেশের আরো দশ জন নারীর মত প্রত্যন্ত পল্লী থেকে এসেছি। কাজের সুবাদে শহরে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে গ্রামেই। আমি চৌগাছাতে যোগদান করার পরই মানুষের জন্য কিছু করার নেশা হয়ে যায়, সেখান থেকে আমর মনে হয়েছে খেজুর গুড় যেমন যশোরের ঐতিহ্য তেমনি এটা একটা ব্রান্ডেড পণ্যও এটাকে যদী হাইলাইটস করা যায় তাহলে এ অঞ্চলের হাজার হাজার গাছিরা লাভবান হবে, সাথে সাথে দেশের মানুষ খেজুরের গুড়ের মত একটা নির্ভেজাল খাবার খেতে পারবে। সেই চিন্তা থেকেই আমি তৎপরতা শুরু করি। তিনি আরো বলেন এতটা সফল হবো এটা কখনো চিন্তা করিনি।সবটাই সম্ভব হয়েছে যশোর জেলা প্রশাসক জনাব তমিজুল ইসলাম খান স্যার ও চৌগাছাবাসীর সহযোগিতার ফলে। আর সেই সাথে সংবাদপত্রের ভূমিকারও প্রশংসা করেন। খেজুর গুড়ের জিআই স্বীকৃতি চৌগাছা তথা যশোরবাসির এক ঐতিহাসিক উপহার। যে উপহারের সাথে ইরুফা সুলতানার নাম জড়িয়ে থাকবে কাল থেকে কালান্তরে। যশোরবাসি আর কখনো ভুলতে পারবে না ইরুফাকে। যশোরের লাখ মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায় থাকুন ইরুফা সুলতানা আর ইরুফার অন্তরে থাকুক যশোরের স্মৃতি এটাই যশোরবাসির প্রত্যাশা।