কালের বিবর্তনে সারা দেশের ন্যায় কালীগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার শোভা বর্ধনকারী শিমুল গাছ। মনোমুগ্ধকর শিমুল ফুল নিয়ে রচিত হয়েছে গান, কবিতা ও গল্প। শিমুল গাছে বসন্তের শুরুতেই প্রতিটি গাছে ফুল ফোটে। চৈত্র মাসের শেষের দিকে ফল পুষ্ট হয়। বৈশাখ মাসের দিকে ফলগুলো পেকে শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে আপনা আপনিই ফল ফেটে প্রাকৃতিক ভাবে তুলার সঙ্গে উড়ে উড়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া বীজ থেকেই এর জন্ম হয়। প্রাকৃতিক ভাবেই শিমুল গাছ বেড়ে উঠে। গাছে গাছে জেগে উঠেছে সবুজ পাতা, মুকুল আর ফুল দেখে বোঝা যায় শীত বিদায় নিয়ে আবার এলো ফাগুন, এলো বসন্ত। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতিকে রাঙিয়ে ফুটেছে শিমুল ফুলের মেলা। কিন্তু কালের বিবর্তনে আগুন ঝরা ফাগুনে চোখ ধাঁধানো গাঢ় লাল রঙের অপরূপ সাজে সজ্জিত শিমুল গাছ এখন বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমান সময়ের অনেক শিশুই চেনেনা শিমুল ফুল কি ও কি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। নিকট অতীতে গ্রামের মানুষ প্রাকৃতিক ভাবে গজিয়ে উঠা শিমুলের গাছের যত্ন আমরা কেউ নিই না। বর্তমানে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি গ্রাম এলাকায় শিমুল গাছ কমে যাওয়ার কারনে স্বাস্থ্যসম্মত তুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। এক সময়ে শিমুল তুলা বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করতে পারতো মানুষ। এ ছাড়াও শিমুল গাছ গ্রামাঞ্চলে ঔষধি গাছ হিসাবে রয়েছে সুপরিচিত। শিমুলের মূল বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু উপকারী ওষধি গাছটি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। শিমুল গাছের চারা রোপণে কৃষকের উদাসীনতার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় বিলুপ্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল। কালীগঞ্জ উপজেলার মানুষ বলছেন, প্রায় ২৫ বছর আগে বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে বাড়ির আনাচে কানাচে চোখে পড়ত অসংখ্য শিমুল গাছ। আর এসব গাছে ফুটন্ত শিমুল ফুলের সমারোহ জানান দিত প্রাকৃতিকে বসন্ত এসেছে। প্রস্ফুটিত ফুলে পুরো এলাকা এক অপরূপ রূপে সজ্জিত হয়ে উঠতো। বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে তুলা ওড়ার মৌসুম। শিমুলের ডালে ডালে শিমুল মোচা বা খোলস রোদের তাপ বেশি হলেই আপনি আপনি ফোটে যায়। মাতাল হাওয়ায় উড়ে যায় ধবল শিমুল তুলা। সামনে আসছে শিমুল তুলা ওড়ার দিন। শিমুল তুলার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ তুলা দিয়ে আরামদায়ক বালিশ, শীতের লেপ, তোষক, নরোম গদিসহ শিশুদের নানা খেলনা পুতুল ও শোপিস তৈরি হয়। এ ছাড়া তুলা গাছের নরোম কাঠ দিয়াশলাইয়ের কাঠি, জ্বালানি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ফলে শিমুল তুলা ও কাঠের একটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। যদিও কালীগঞ্জে শিমুল গাছের কোন পরিকল্পিত বাণিজ্যিক আবাদ নেই। গ্রামের পথের পাশে অথবা ঘর বাড়ির আনাচে কানাচে শিমুল গাছ এখন প্রকৃতিগত ভাবে জন্মে থাকে। কেউ আবার শখে করে দুই একটি শিমুল গাছ লাগান। দক্ষিণা বাতাসে আম্র মুকুলের মৌ মৌ ঘ্রানে মুগ্ধ চারিদিক। কোকিলের সুমিষ্ট কুহুতালে ফাল্গুনের উত্তাল বাসন্তী হাওয়া দিচ্ছে দোলা। গাছে গাছে জেগে উঠেছে সবুজ পাতা। মুকুল আর শিমুল ফুল দেখে বোঝা যায় শীত বিদায় নিয়ে এসেছে ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃতিকে রাঙিয়ে ফুটছে শিমুল ফুল। শিমুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম “বোম্বাক্স সাইবা লিন”।এটি বোমবাকাসিয়াক পরিবারের উদ্ভিদ। বীজ ও কান্ডের মাধ্যমে এর বংশবিস্তার হয়। রোপণের ৫-৬ বছরের মধ্যে শিমুল গাছে ফুল ফোটে। ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। সেই তুলনায় বেশ মোটাও হয়। নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিমুল গাছ দেড়শ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। শীতের শেষে পাতা ঝরে পড়ে। বসন্তের শুরুতেই গাছে ফুল ফোটে। আর এ ফুল থেকেই হয় ফল। এই শিমুল ঔষধি গাছ হিসেবে পরিচিত রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিষফোঁড়া ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে এ গাছের মূল ব্যবহার করত। আগে গ্রামে প্রচুর শিমুল গাছ ছিল। এ গাছের সব অংশেরই রয়েছে ভেষজ গুণ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা এখনো নানা রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে। প্রাকৃতিক ভাবে তুলা আহরণের অন্যতম অবলম্বন ছিল শিমুল গাছ। অন্যান্য গাছের মত এ গাছ কেউ শখ করে লাগায় না। নেওয়া হয় না কোন প্রকার যত্ন। অযত্ন আর অনাদরে প্রাকৃতিক ভাবেই গাছ বেড়ে ওঠে। এ গাছের প্রায় সব অংশই কাজে লাগে। এর ছাল, পাতা ও ফুল গবাদিপশুর খুব প্রিয় খাদ্য। শিমুল গাছ উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের উপরে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। এ গাছ অনেক উঁচু হওয়ায় কাক, কোকিল, চিল, বকসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি বাসা বেঁধে বসবাস করত। এ গাছ উজাড় হওয়ার ফলে এসব পাখিরা আবাসস্থল হারিয়ে ফেলেছে। গাছ না থাকায় আবাসস্থলের অভাবে ধীরে ধীরে এসব পাখিরাও হারিয়ে যাচ্ছে। বালিশ, লেপ ও তোষক তৈরিতে শিমুল তুলার জুড়ি নেই। অথচ বর্তমানে মানুষ এ গাছকে তুচ্ছ মনে করে কারণে অকারণে কেটে ফেলছে।