অল্প কয়েকদিন পরেই ঈদ কিন্তু তাতের কাপড়, গামছার কোন চাহিদা নেই।একসময় বাংলাদেশের এমন কোনো গ্রামগঞ্জ ছিল না, যেখানে দু-একটি তাঁতিপাড়া চোখে পড়ত না। সকাল থেকেই শুরু হতো খটখট শব্দ, চলত তা গভীর রাত পর্যন্ত। কোনো একটি পরিবার, পুরো একটি সম্প্রদায়, বংশের পর বংশ ধরে নির্ভর ছিল হাতে তৈরি এ যন্ত্রটির ওপর। পরনের সমস্ত কাপড়, গামছা-লুঙ্গি-শাড়ি থেকে শুরু করে রুমাল বালিশের কভার পর্যন্ত বোনা হতো তাঁতের কাপড়ে। আদিকাল থেকে মানুষের লজ্জা নিবারণের এ যন্ত্র এখন বিলুপ্ত প্রায়। তার বিভিন্ন স্থানে দখল করে নিয়েছে বড় বড় কল-কারখানা-গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি।তাঁতের যন্ত্রটি এমন একটি যন্ত্র যার প্রতিটি যন্ত্রাংশই হাতে চালিত এবং হাতেই ব্যবহূত। তবে আধুনিক সময়ে এসে অনেক কল-কারখানায় স্বয়ংক্রিয় তাঁতযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে মেশিনের সাহায্যেই তাঁত চলে। তাঁত বোনা শব্দটি এসেছে ‘তন্তু বয়ন’ শব্দ থেকে। তাঁতিদের অনেক জেলায় ঝোলা বা জুলি বলা হয়। কারণ তাদের ঝোলানো হাতল টেনে তারা কাপড় বুনেন। তাঁতিরা যে শুধু দেশীয় প্রয়োজন মেটাতেন তা নয়, তাদের উৎপাদিত কাপড় বাণিজ্য করতে যেত ভারতবর্ষসহ বহির্বাণিজ্যেও। এক সময় ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের হেলাই গ্রামের তাতের শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছার ছিল ব্যাপক চাহিদা। এ গ্রামের কাপড় দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে বিক্রি করতো। ঝিনাইদর কালীগঞ্জ উপজেলার কয়েক হাজার তাঁতকল আজ বন্ধ হতে চালেছে। বেশকিছু তাঁতী পরিবার এখনো পৈত্রিক ব্যবসাকে আঁকড়ে ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কালীগঞ্জ উপজেলারহেলাই, শালিখা, মস্তবাপুর, ফরাসপুর, আড়ুয়াসলুয়া, চাপরাইল, অনুপমপুর, রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষই তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। বর্তমানে অনেক তাঁতকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ দিন কাটছে তাদের।অনেকে পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে এখন হয়েছেন রিকশা-ভ্যান চালক। আবার অনেকে বিভিন্ন গার্মেন্টসের কাপড় ক্রয় করে এনে গ্রামগঞ্জে বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন। কালীগঞ্জ হেলাই গ্রামের এক তাঁত মালিক আব্দুস ছাত্তারের বাড়িতে ২৫টি তাঁতকল ছিল। তিনি নিজে কাপড় বুননের কাজ করতেন না। গ্রামের অস্বচ্ছল গরীব কারিগররা চুক্তিভিত্তিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। বাজারে দেশি তৈরি তাঁত কাপড়ের চাহিদা কম হওয়ায় তিনি সব তাঁতকল বিক্রি করে দেন।সেই প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্প কাপড় তৈরিতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। শুরু থেকে তাঁতশিল্পের ভূমিকা ছিল নানা রকম শৌখিন, কারুকার্যময় পোশাক তৈরিতে। তবে প্রয়োজনের তাগিদে তাদের প্রান কাজ ছিল নিত্য প্রয়োজনীয় সাধারণের পোশাক বানানোই। দেশীয় তুলা থেকে সুতা উৎপাদন করে তাঁতিরা নিজেরাই কাপড় তৈরি করে নেন। বেশির ভাগ তাঁতি সুতা বাজার থেকে কিনে নেন। প্রয়োজনীয় কাপড়ের মাপ, নকশা নিজেই তৈরি করেন।তাঁতিদের কারিগর বলা হলেও তারা প্রত্যেকেই একেকজন শিল্পী। যদিও আদিকাল থেকেই তাদের অবস্থা দিন আনি দিন খাইয়ের মতোই। এক গজ কাপড় তৈরিতে তাদের সারা দিন লাগলেও বর্তমানে তারা দৈনিক ৪০০থেকে ৫০০ টাকার বেশি মজুরি পান না। বংশ পরম্পরায় এ পেশা চলে আসার কারণে দেশভাগের পর যখন আধুনিক শিল্প-কারখানা তৈরি হতে থাকে, তখন অনেক পরিবারের উত্তর-প্রজন্ম কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তাদের করুণগাথা লেখা আছে বাংলা ভাষার অসংখ্য সাহিত্যে। কালীগঞ্জ উপজেলায় বেশকিছু তাঁত রয়েছে,রয়েছে সুযোগ্য কারিগর। যারা পৈত্রিক ব্যবসাকে এখনো কোন রকমে টিকিয়ে রেখেছে।এখান থেকে তারা উৎপাদন করছে সুতি গামছা, লুঙ্গি ও শাড়ী ছাড়াও সিলকের তৈরি শাড়ী। সিলকের শাড়ীর প্রচুর চাহিদা থাকা সত্বেও কাঁচামালের অধিক মূল্যের কারণে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।তাঁত শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কারণেই ১৯৪৬ সালে কালীগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হেলাই তন্তুরায় সমবায় সমিতি লিমিটেড। তাদের এখন দুর্দিন যাচ্ছে। সরকার সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করলে ও উপকরণ সরবরাহে আন্তরিক হলে দেশে তাঁত শিল্পের আবারও বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।ঐতিহ্যবাহী হস্তচালিত তাঁত শিল্পের আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেও বর্তমানে এর অবস্থা খুবই করুণ। যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে টিকতে না পেরে বিলুপ্তির পথে এখন প্রাচীন এই শিল্পটি।কালীগঞ্জ উপজেলার হেলাই গ্রামটি তাঁত শিল্পের গ্রাম হিসেবে বেশ পরিচিত। যে কয়েকজন এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে উচ্চমূল্যের কাঁচামাল আর কমতির দিকে থাকা চাহিদার সঙ্গে। এসব কারণে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া এই পেশাটি।যারা এখনো টিকে আছেন, মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। যেকোন সময় তারাও এই পেশাটিকে চিরতরে বিদায় জানাতে পারেন।তাঁত-সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে হেলাই গ্রামটি পরিচিতি ও সুনাম ছিল দেশজুড়ে। হেলাই গ্রামের তৈরি তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানার চাদর সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এমন কি দেশের বাহিরেও রফতানি করা হতো।৩শ পরিবারের গড়ে ওঠা তাঁত শিল্প কেন্দ্রিক কালীগঞ্জ,ঝিনাইদহ,যশোর,কুষ্টিয়াম ঢাকা, বরিশাল, মাগুরাসহ বিভিন্ন এলাকার বাজারে প্রতিদিন কাপড় কেনাবেচা হতো।পরবর্তীতে সুতা, রঙসহ তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন কাঁচামালের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও দিন দিন বাজারে তাঁতের কাপড়ের চাহিদা কমে আসায় লোকসানের মুখে পড়তে থাকেন তাঁতিরা। অব্যাহত লোকসানের মুখে অনেকে বাধ্য হয়েছেন পেশা পরিবর্তন করতে। কেউ বা আবার নেশায় পড়ে এ পেশা ধরে রেখেছেন। রফিকুল ইসলাম নামের আরেকজন জানান, তার আছে ২ টা তাঁত। পারিবারিক ভাবে স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধু নিয়ে এই কাজই করছেন। একটি তাঁতে প্রতিদিন ৪ থানে গামছা হয় ৮ টা, যার পাইকারি মুল্য ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। এই গামছা তৈরীর সুতা আনতে হয় কুষ্টিয়ার বিত্তীপাড়া থেকে। নিজেদের পরিশ্রম, সুতা, রং, চরকা, মাকুর খরচ দিয়ে পোশানো অনেক কষ্টের। পৈতৃক কাজ ছাড়তে পারছেন না বলেই তারা এ ব্যবসা আজও ধরে রেখেছেন। তিনি বলেন, তাঁতের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে মন খারাপের কিছু নেই। কেননা প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। তাজুল ইসলাম জানান, এখন শাড়ীর কাজ হয়না বললেই চলে, কারন শাড়ীর খরচ পুুসিয়ে মুল্য পাওয়া কষ্ট। তাঁতের একটি শাড়ী তৈরীতে সময় লাগে প্রকারভেদে এক থেকে দুই দিন। খরচও লাগে প্রকার ভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। যা বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা। তাঁতের শাড়ী থেকে মেশিনে তৈরী শাড়ীর চাকচিক্য থাকে বেশি। সময়ের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গেলে ব্যবসায়ীক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রয়োজন। যা এই তাঁত শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা পাচ্ছেন না। এ পেশার সাথে জড়িত মানুষের জন্য নেই প্রয়োজনীয় পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিকসনের কোন ব্যবস্থা।