এক সময় গ্রাম বাংলা মানেই মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনির ঘরের দৃশ্য চোখে পড়ত,কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ ঘর গুলো এখন বিলুপ্তির পথে। এসব ঘর এখন আর বেশি একটা দেখা যায় না। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়,যেখানে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার প্রতিটি গ্রামে চোখে পড়তো প্রায় এক তৃতীয়াশ মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনির তৈরি ঘর। কালীগঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরেও সেই মাটির দেওয়াল বিশিষ্ট খড়ের তৈরি ঘর তেমনটা আর চোখে পড়েনি। তাছাড়া এসব ঘর তৈরির কাজে নিয়োজিতদের অনেকেই ইতোমধ্যে তাদের পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চোলে গেছেন।
গ্রামের অনেকেই বলছেন,আগেকার দিনের মাটির তৈরি দেওয়াল ও খড়ের ছাউনির তৈরি ঘরের জায়গাা গুলো দখল করে নিয়েছে ইট,বালি,পাথর,সিমেন্ট,লোহার রড,টিন ও কংক্রিটের ব্লকের তৈরি বড় বড় বিল্ডিং-অট্টালিকা। বিল্ডিং তৈরিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় তারাও কর্ম হারিয়েছেন। ফলে মাটির দেওয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনির ঘর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে টিনের ছাউনির কাজ বেছে নিয়েছেন। একই কথা জানিয়েছেন আড়পাড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম। তাছাড়া অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ইজিবাইক,রিকসা,ইটভাটার শ্রমিক,ভ্যান চালকের পেশা বেছে নিয়েছেন। রামনগর গ্রামের মহিদুল ইসলাম,পাইকপাড়া গ্রামের সাখাওয়াত হোসেন বলেন,মাটির দেয়াল বিশিষ্ট ঘরের খড়ের ছাউনি থাকার ফলে গরমের সময় ঠান্ডা ও ঠান্ডার সময় গরম অনুভূত হত।
বর্তমানে এ জায়গা দখল করেছে এখন এসি। সেই সময় ঘরের চালের ছাউনির উপর নির্ভর করেও অনেকের ব্যক্তিত্ব পরিমাপ করা হতো।অথচ ইট,বালি,লোহার রড ও সিমেন্ট,বর্তমানে অত্যাধুনিক কংক্রিট ব্লকের ভিড়ে মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনির ঘর তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে। এমদাদ হোসেন জানান, কালীগঞ্জ উপজেলার গ্রাম এলাকায় একসময় দেখা মিলতো মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনির একটি ঘর। বর্তমানে এখন ফলে আধুনিকতার ছোঁয়ার কারণে এসব এখন চোলে মেলে না। স্থানীয়রা জানান,পূর্বেকার সময়ে গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের বাড়িতে বাড়িতে প্রতিটি সুন্দর ছাউনির পরিপাটি ছনের চালার ঘর। মাটির দেয়াল কিংবা বাঁশের বেড়ার ও ঘরের ছাউনির জন্য একমাত্র অবলম্বন ছিলো ছন। প্রায় ৩/৪ বছর পরে শুষ্ক মৌসুমে ছন সংগ্রহ করে শ্রমিক লাগিয়ে ঘরের ছাউনি দেয়া হতো। এগুলো ছিলো গ্রামের ঐতিহ্য।
কেউ কেউ ছন কেটে শুকিয়ে আটি বেঁধে বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠত ছনখলা। সেখানে ছনের অভয়ারন্যের পাশাপাশি দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থলও গড়ে উঠতো। দরিদ্র পরিবার সদস্যরা ছন সংগ্রহ করতে না পারায় ধান গাছের খড়,বিচালি সংগ্রহ করে ঘরের ছাউনির কাজ সেরে নিতেন। এভাবেই বছরের পর বছর গ্রামীন বাড়ির অধিকাংশ ঘরে ছনের ছালা শোভা পেত। ঘরের ছনের চালার মধ্যে চড়ুই, ঘুঘু, শালিক পাখিও বাসা বাঁধতো। স্থানীয়দের মতে ছনের চালার ঘর ছিল খুবই স্বাস্থ্য সম্মত। তবে সময়ের পরিক্রমায় ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন ছনের চালার ঘর গুলো বিলুপ্ত হতে চলেছে।
কালীগঞ্জের সমাজকর্মী শিবুপদ বিশ্বাস বলেন, ছনের ঘর গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা ও শীতকালে গরম থাকে। তাই ছনের চালার ঘরে বসবাস ছিল স্বাস্থসম্মত। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে ছনের ঘর তেমন চোখে পড়ে না। ইট-রড, বালু, সিমেন্ট ও টিন গিলে খেয়েছে ছনের ঘর। তবে বিত্তবান ও শৌখিন কেউ কেউ এখনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কিংবা ফ্যাশন হিসাবে নিজেদের বাড়ির কোন কোন ঘরের উপরে ছনের চালা দেয়ার চেষ্টা করেন। আগের তুলনায় মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জীবন যাত্রার মানেরও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
আর তাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী মাটির দেয়াল বিশিষ্ট খড়ের ছাউনি ঘরের চিহ্নটি। হয়ত সেই দিন আর বেশি দূরে নয়,খড়ের ছাউনির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম রূপকথার গল্পে এই ঘরকে স্থান দিতে স্বাছন্দবোধ করবে। অনেক ছেলে মেয়েরা খড়ের তৈরি ঘর নাকি চোখে দেখেনি।
গ্রাম বাংলার আদি ঐতিহ্য মাটির ঘর। চারদিক মাটির দেয়াল,উপরে টিন বা ছনের ছাউনি বয়োজোষ্টদের মনে করিয়ে দেয় তাদের শৈশব। কনকনে শীতে ঘরের ভেতর উষ্ণ পরিবেশ ও গরমকালে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বিরাজ করায় মাটির ঘর গরিবের কাছে যেমন আরামের তেমনি ধনীদের কাছে ছিল বিলাসিতা। তবে যুগের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে অস্তিত্ব বিলীনের পথে মাটির ঘর।এক সময় গ্রাম এলাকায় বাড়িতেই দেখা যেত এই মাটির ঘর। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে পূর্বপুরুষের তৈরি ঘরগুলো এখন ইট,বালু,রড,সিমেন্টের ঘরে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর যাদের সামর্থ্য নেই তারা করছেন টিনের ঘর।ঘরগুলোর নির্মাণ কৌশলও কত সুন্দর পানির সঙ্গে মাটির প্রলেপ মিশিয়ে লেপে নিলেই কোনো ফাটল দেখা যায় না।
কোনো কোনো সময় অতিবৃষ্টি কিংবা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরগুলো বেশি নষ্ট বা ফেটে গেলে সিমেন্ট দিয়েও লেপে দেওয়া যায়।পরিচ্ছন্ন মাটির সঙ্গে পানি মিশিয়ে কাদায় পরিণত করে ইটের মতো সারি সারি করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়। প্রতিবারে এক দেড় ফুট উঁচু করে ক্রমে শুকিয়ে গেলে খড় বা টিন দিয়ে ছাউনি দেওয়া হতো। প্রতিটি ঘর তৈরিতে দেড়-দুই মাসের মতো সময় লাগে। তবে মুষলধারে বৃষ্টিতে মাটির ঘরের স্বাভাবিক কাঠামো নষ্ট হওয়ায় লোকজন এই ঘর তৈরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। গ্রাম এলাকায় মাটির ও খড়ের ঘর খুবই কম দেখা যায়।