সীমান্তের ওপারে অভিন্ন নদী সমূহের প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে বৃষ্টির অভাবে সাগরের জোয়ার ক্রমাগত উজানে উঠে আসছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলে গত কয়েক বছর লবনাক্ততার মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির সাথে নাব্যতা সংকটও প্রকট আকার ধারন করছে।
এ অঞ্চলের ছোট-বড় ১৩২টি নদণ্ডনদীতে লবানক্ততার মাত্রা বৃদ্ধির সাথে নাব্যতা সংকটে নৌ-যোগাযোগ ও মৎস্য সম্পদ চরম হুমকির মুখে পরেছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড, মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট, মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট ও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা। সূত্রমতে, সীমান্তের ওপারে অব্যাহত প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নদণ্ডনদী সমূহে পলি জমে ধারন ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষা মৌসুমে উজানের ঢলের পানি সাগরে প্রবাহের সময় বাড়ছে ভাঙনের তীব্রতাও। সুষ্ঠু প্রবাহের অভাবে ইলিশের বিচরনস্থলের পরিবর্তন ঘটছে। এমনকি নদণ্ডনদীর প্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত হওয়াসহ নাব্যতা সংকটের সাথে চলমান তাপ প্রবাহে নদণ্ডনদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ইলিশ ক্রমাগত গভীর সমুদ্রে চলে যাচ্ছে। অথচ সারাদেশে উৎপাদিত ও সহনীয় আহৃত ইলিশের ৭০ ভাগই বরিশাল অঞ্চলের।
সূত্রে আরও জানা গেছে, শুস্ক মৌসুমে উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ, বলেশ্বর ও বুড়িশ্বরসহ বরিশাল অঞ্চলের ছোট-বড় ১৩২টি নদণ্ডনদী নাব্যতা সংকটে ধুকছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের শেষভাগ পর্যন্ত শুস্ক মৌসুমের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে অনেক বড় নদীতেও নৌযান চলাচল করেছে গভীরতা মেপে। বরিশাল-চাঁদপুর-ঢাকা, বরিশাল-ইলিশা-লক্ষীপুর-চট্টগ্রাম নৌপথ ছাড়াও বরিশাল-মোংলা-খুলনা নৌপথের গাবখান ও ঘাশিয়াখালী চ্যানেলগুলোর নাব্যতা সংকট অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় নৌ-যোগাযোগে প্রতিনিয়ত সংকট সৃষ্টি করছে।
তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নৌপথে যাত্রী পরিবহন কমে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের দৃষ্টি অন্যত্র সরে গেছে বলে মনে করছেন নদী বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মহাসড়ক ও সেতু কখনো নৌ-পথের গুরুত্বকে হ্রাস করতে পারেনা। কারণ এখনো নৌপথে পরিবহন ব্যয় সড়ক পথের অর্ধেকেরও কম এবং নিরাপদ। পাশাপাশি নৌপথের সংরক্ষন ও উন্নয়ন সড়ক পথের চেয়ে অনেকটাই সাশ্রয়ী। পাশাপাশি নদী দেশের কৃষি, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জলবায়ু রক্ষায় অনেকটাই হ্রদ স্পন্দনের কাজ করে।
একাধিক নদী গবেষনা প্রতিষ্ঠানের মতে, সীমান্তের ওপার হয়ে অভিন্ন ৫৪টি নদণ্ডনদীর যে পানি সাগরে পতিত হয়, তার ৭৮%-ই মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বুড়িশ্বর ও বলেশ্বরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদণ্ডনদী বহন করে থাকে। কিন্তু প্রতিবছরই উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনসহ যথাযথ সংরক্ষন ও উন্নয়নের অভাবে নদণ্ডনদী সমূহ শুস্ক মৌসুমে ক্রমাগত ভরাট হয়ে ধারন ক্ষমতা হ্রাসের ফলে বর্ষাকালে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। অথচ গত ১৫ বছরে দেশের নদণ্ডনদীর ভাঙনরোধে এ যাবতকালের সর্বাধিক নদী শাসন রোধ প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। যা এখনো চলমান রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শুধু দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গত কয়েক বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশী ব্যয়ে ১৫টি নদী শাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার বেশীরভাগই বাস্তবায়নাধীন। ইতোমধ্যে কয়েকটি ভাঙনরোধ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এরপরেও অতি জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকার ভাঙনরোধে এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার চাহিদা রয়েছে। কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রসহ সমুদ্র সৈকত রক্ষায় একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা থেকে সাড়ে সাতশ’ কোটি হয়ে সাড়ে ১১শ’ কোটি টাকায় উন্নীত হবার পর, পুনরায় সাড়ে সাতশ’ কোটিতে নামিয়ে আনা হলেও তা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ফাইলের জ্যামে আটকে রয়েছে।
সূত্রমতে, ভাঙনরোধে নদী তীর রক্ষা ও ড্রেজিং-এর সময়োচিত পদক্ষেপের অভাবে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের আশীর্বাদ ১৩২টি নদণ্ডনদী এখন অনেকটাই দুঃখে পরিনত হয়েছে। এমনকি গত কয়েক বছর ধরে শুস্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের নদণ্ডনদীর প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের প্রায় পাঁচশ’ কিলোমিটারে নাব্যতা সংকট ভয়াবহ ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। একই কারণে প্রায় তিন লাখ টন মাছ উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলের বিপুল মৎস্য সম্পদের ভবিষ্যতও ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
অপরদিকে নদী ভাঙন এখনো সারাদেশের মতো দক্ষিণাঞ্চলের ভয়াবহ অভিশাপ হয়েই রয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ দক্ষিণাঞ্চলের ১৩২টি নদণ্ডনদীর ভয়াবহ ভাঙনে সকাল বেলার আমীরকে সন্ধ্যায় ফকির বানাচ্ছে। এমনকি শুস্ক মৌসুমে সীমান্তের ওপারে বিবেকহীন প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে নদণ্ডনদী বহুল দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতা সংকট ক্রমগত ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। একইসাথে সাগরের লবানাক্ত পানি একশ’ কিলোমিটার উজানে বরিশাল ছাড়িয়ে গত কয়েক বছর ধরে আরো ৫০ কিলোমিটার উত্তরে চাঁদপুরের ভাটিতে হিজলা উপজেলার মেঘনা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের নদণ্ডনদীর ওপরই দেশের তিনটি সমুদ্র বন্দরসহ সারাদেশের সাথে নৌ-যোগাযোগ নির্ভরশীল। এমনকি পায়রা সমুদ্র বন্দরটি সম্পূর্ণভাবেই দক্ষিণাঞ্চলের নদণ্ডনদী নির্ভর। মেঘনাসহ বড় কয়েকটি নদণ্ডনদীর নাব্যতা সংকটে পায়রা ও মোংলা বন্দরসহ দক্ষিণাঞ্চলের সাথে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের এবং চট্টগ্রামের নৌ-যোগাযোগে ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। ভোলার ইলিশা থেকে লক্ষীপুরের মজুচৌধুরীর হাট পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার প্রশস্ত ভাটি মেঘনায় ডুবোচরে উপণ্ডমহাদেশের দীর্ঘতম ফেরি সার্ভিসসহ সবধরনের নৌযান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। অথচ এ নৌপথটির ওপরই চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সারাদেশের নৌ যোগাযোগ নির্ভরশীল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি, ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা ছিল ৬১০-৬৩০ পিপিএম। সেখানে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তা ৯১০ পিপিএম-এ পৌঁছে। ২০১৮ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ২০১৯ সালে একই নদীতে লবনাক্ততার মাত্রা আবার নয়শ’ পিপিএম অতিক্রম করে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতেও লবনাক্ততার মাত্রা প্রায় নয়শ’ পিপিএম’র কাছে থাকলেও ২০২১ সালের এপ্রিলের শুরু থেকে কীর্তনখেলায় তা এক হাজার পিপিএম অতিক্রম করে। এর পরবর্তী বছরগুলোতে লবনাক্ততার মাত্রা বিপদসীমার নীচে থাকলেও তা অনেক সময়ই ‘বর্ডার লাইন’র কাছে চলে আসে।
সূত্রমতে, উজানে প্রবাহ নিয়নস্ত্রনসহ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে ২০২১ সালের শুস্ক মৌসুমে সাগরের নোনা পানি গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীতে পৌঁছে সর্বকালের সর্বোচ্চ ২১শ’ পিপিএম লবনাক্ততা শনাক্ত হয়। যা ২০১৬ সালে ছিলো ১২শ’ পিপিএম। অথচ কৃষি ও মৎস্য সম্পদসহ মানবদেহের জন্য সহনীয় লবনাক্ততার মাত্রা ছয়শ’ পিপিএম।
পরিবেশবীদদের দাবী, উজানে বিবেকহীন প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে বিগত ২০২১ ও ২০২২ সালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে নদীর দেশ দক্ষিণাঞ্চলের নদণ্ডনদী সমূহে ক্রমাগত তার চরিত্র বদলাচ্ছে। এমনকি গতবছরও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ব্যাপক ঘাটতির পরে শরৎ পেরিয়ে হেমন্তে প্রবল বর্ষনে উঠতি আমন ও আগাম রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। একইসাথে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারন করে। যা কৃষি ও মৎস্য সম্পদসহ সুস্থ মানব সভ্যতাকে ক্রমাগত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।