গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ফেটালিয়া ও নাশেরা গ্রামের দুই’শ কৃষকের প্রায় ৪’শ বিঘা জমির বোরো ধান ইট ভাটার আগুনের তাপে নষ্ট হয়ে গেছে। ইট ভাটার আগুনের তেজস্ক্রিয়তায় পাশের দড়িনাশেরা গ্রামের কৃষকদেরও ক্ষতি হয়েছে। ইট ভাটার গ্যাসে কৃষকদের আবাদি জমির ফসল পুড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ওইসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে উপজেলা কৃষি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমির ফসল পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ণয় করে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করার আশ্বাস প্রদান করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় প্রায় ৩০০ বিঘা জমির ফসল পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিভিন্ন ফলজ গাছপালা ও সবজির বাগান। ফসলের ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে কৃষক পরিবারের। এলাকার কৃষকরা জানান, ঈদের আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে ইটেরভাটাটি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে যায় অনুমোদন না থাকায়। এই ইটের ভাটাটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায় থাকায় বন্ধের দাবি করে আসছিল এলাকাবাসী। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকলেও ইট পোড়ানো হয় এ ভাটায়। কয়েকদিন পরপর ইট ভাটায় কয়েক দফায় অভিযান চালায়। কিন্তু পরবর্তীকালে অদৃশ্য কারণে ইট পোড়ানো হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগ নিরবতা পালন করে বলে কৃষকেরা দাবি করেন।
স্থানীয়রা জানায়, ২০১২ সাল থেকে কাপাসিয়ার তারাগঞ্জের ফেটালিয়া গ্রামে এসকেএস ইট ভাঁটা স্থাপিত হয়। হাত বদল হওয়ার সাথে সাথে নামেরও পরিবর্তন হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে কর্তৃপক্ষ ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কখনো ফেটালিয়া ব্রিক ফিল্ড, ভাই ভাই ব্রিক ফিল্ড নামে ইটভাটা পরিচালনা করলেও বর্তমানে এস আর এফ নামে ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এ ইটভাটার ২০০ ফিট দূরত্বের মধ্যে স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ ও ঘনবসতি রয়েছে। ভাটার কালো ধোঁয়ায় ওই গ্রামের বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছে ফুল-ফল থাকে না। সব কিছু অকালেই ঝড়ে যায়। প্রতি বছর যে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারন করে তা হলো ফসলের মাঠ কালো ধোঁয়া ও তাপে পুড়ে যায়। বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ আগুনের তাপে পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলেন, উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ফেটালিয়া ও নাশেরা গ্রামটি ধান উৎপাদনে ব্যাপক প্রসিদ্ধ। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষের আয়ের মূল চালিকা শক্তি ফল উৎপাদন ও কৃষির বিভিন্ন ফসল।
কৃষক মোঃ বুরুজ আলী বলেন, তিনি এ বছর ৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। ধানে দুধ আসার পরপরই ভাটার আগুনের তাপে সেই ধান পুড়ে গেছে। টাকা ধার করে জমি চাষ করেছি। সেই ধারের টাকা এখন কিভাবে পরিশোধ করবো তার কোন আর পথ নেই।
কৃষক মোঃ রফিকুল বলেন, এবছর ১৫ শতাংশ জমিতে ধানের চাষ করেছি। এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারব না। ইটের ভাটার আগুনের তাপে সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। গরুকে খাওয়ানোর যে কুটা (খড়) খাওয়াবো তারও কোনো উপায় নেই। আগুনের তাপে ঝলসে যাওয়া খোর গরুও খেতে চায় না। এখন গরু কি খাবে আমরাইবা কি খাব ! তাই এখন ভাবছি।
কৃষক আঃ হাই জানান, তিনি এবং তার ভাই আনোয়ার দুজনে একসাথে ৬ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। আবাদি জমির পাশে ইট ভাঁটা নির্মাণ হওয়ায় প্রতি বছরই আমাদের ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। এবছর ইটের ভাটার আগুনের তাপে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে, যা কোনভাবেই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব না। ওই জমির ফসল দিয়েই আমাদের সারা বছর খাবার যোগান হয়। কিভাবে যাবে দিন ধান তো পুড়ে গেছে সব খাব কি।
কৃষক জসীমউদ্দীন বলেন, আমার এক বিঘা জমির ফসল নষ্ট হইছে। এই এক বিঘা জমির ধান দিয়ে সারা বছর খাবার যোগাই। এটাই আমার একমাত্র আয়ের জায়গা। এখন আমি কী করবো ? আমার স্বপ্ন ক্ষেতেই পুড়ে গেলো। শুধু আমি নই, এই এলাকার শতাধিক কৃষকের স্বপ্নের ফসল এই ভাটার গ্যাসে ও আগুনের তাপে নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের এই ক্ষতিপূরণ কে দিবে আমরা এর ক্ষতিপূরণ চাই।
কৃষক মোঃ জব্বার মিয়া জানান, ঋণ করে এ বছর দুই বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছি। কিছুদিনের মধ্যে ধান ঘরে তোলা যেতো। ইটভাটার আগুনের তাপে পুড়ে গেছে তার স্বপ্নের ফসল। এখন ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা পরিবার পরিজনের খাদ্যের যোগান নিয়েও শঙ্কায় আছি।
উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ফেটালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মঞ্জুর হোসেন বলেন, দুই শতাধিক কৃষকের ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতিপূরণ পেতে কৃষকেরা আমার সাথে যোগাযোগ করছে। কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা এখনও বলা যাচ্ছে না।
কৃষক আবদুল বাতেন বলেন, জমিতে কাজ করতে গিয়ে ভাটার ধোঁয়ায় তার বাবার তীব্র শ্বাস কষ্টের সমস্যা দেখা দেয়। গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছি। এই এলাকায় যেন কোন ইটেরভাটা না থাকে প্রশাসনের কাছে দাবি করছি।
ইট ভাটার মালিক রমিজ উদ্দিন রমি বলেন, আগুনের তাপে ধানের ফুল আসার সময় কিছু কৃষকের ফসল নষ্ট হইছে। পরে কৃষকরা মিলে ইট ভাটার গেইটে তালা মেরে রাখেন। কৃষকদের ক্ষতিপূরন দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে আমার ইটেরভাটাটি বন্ধ রয়েছে। আমি জানিনা। আমি এখনো ইটেরভাটাটি অনুমোদন (লাইসেন্স) করতে পারিনি।
কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার মঞ্জুরুল আমিন বলেন, কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত ফলজ গাছ ও ধানের ফসল পরিদর্শন করেছি। কৃষকদের ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যেসব কৃষকের ফসলের ক্ষতি হয়েছে তাদের তালিকা করে উপজেলা কৃষি অফিসে জমা দেয়া হবে।
কাপাসিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের একটি তালিকা করে এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ণয় করে তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এবং এই বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।