এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিকভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় রাঙ্গামাটি জেলা সদরের সাথে ৬ উপজেলা সদরের সাথে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ হতে বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি, নানিয়াচর ও বিলাইছড়ির এসব উপজেলাগুলোতে যাত্রীবাহী লঞ্চ যেতে পারছে না। কাপ্তাই হ্রদে নৌ চলাচলের পথ শুকিয়ে যাওয়ায় জেলার ছয় উপজেলায় লঞ্চে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে অসহনীয় দূর্ভোগ।
১৯৬০ সালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে সৃষ্টি হয় সাতশত বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের দীর্ঘতম কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের। বর্তমান শুস্ক মৌসুমে এবারো অস্বাভাবিক ভাবে শুকিয়ে গেছে কাপ্তাই হ্রদের পানি। হ্রদের বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর ও টিলা। হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদরের জেটিঘাট দুরে সরে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল। বাঘাইছড়ি, লংগদু, বরকল, জুরাছড়ি, নানিয়াচর, বিলাইছড়ির হাজারো মানুষকে ইঞ্চিন চালিত ছোট বোটে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ছোট বোট বা স্পীড বোটে যাত্রীরা চলাচল করলেও সেটি এখন বন্ধ হওয়ার পথে।
ফলে পানি পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনে বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে রাঙ্গামাটির দূর্গম পার্বত্য এলাকায়। এসকল কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিরূপ প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলে। বিশেষ করে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রত্যন্ত এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রায়। একই কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সর্বনিম্ম পর্যায়ে ঠেকেছে।
বাঘাইছড়ি প্রেস ক্লাবের সভাপতি দীলিপ কুমার দাশ জানান, উপজেলার সাথে জেলা সদরের নৌ পথে যাতায়াত ব্যবস্থার সমস্যা দীর্ঘ বছরের। প্রতি বছর এই সময়ে বাঘাইছড়িসহ ৫ উপজেলার মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকে না। আর প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পলি জমে তলদেশ ভরাট হওয়ায় হ্রদ নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। এতে করে হ্রদের বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবোচর ও টিলা। এতে করে প্রতিবছর ৬ উপজেলায় এই সময়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর এতে করে নদীপথে যাত্রীদের দুর্ভোগ ও নিদারুন কষ্ট ভোগ করতে হয়। অপরদিকে শিশু বাচ্চা ও গর্ভবতী মা বোনদের যে হারে কষ্ট হয় তা না দেখে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না।
রাঙ্গামাটি লঞ্চ মালিক সমিতি সভাপতি মোঃ মঈন উদ্দিন সেলিম বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ৬ উপজেলায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। আর যাত্রী এবং মালামাল ছোট ইঞ্চিন বোটের মাধ্যমে পরিবহন করা হচ্ছে। তারপরও শুভলং এর পরে গিয়ে বোটগুলো ডুবোচরে আটকে যাচ্ছে। এতে করে ২/৩ ঘন্টার রাস্তা যেতে লাগছে ৫/৬ ঘন্টা।
তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর এই মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদে পানি কমে গিয়ে ডুবন্ত চর জেগে উঠলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব বিষয়ে নদী রক্ষা জাতীয় কমিটি ও নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ে অনেক বার চিঠি লিখেছি। জেলা প্রশাসকগন অনেক বার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তার পরেও কাপ্তাই হ্রদ ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হচ্ছে না। সরকারবে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব দিয়েও লঞ্চ চালাতে পারচ্ছি না। বর্তমানে ৬ উপজেলায় যাত্রীবাহী সবকটি লঞ্চ বসে আছে। বেকার হয়ে পড়েছে লঞ্চ ষ্টাফরা। তাই হ্রদের নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে সব পয়েন্ট ড্রেজিং করা প্রয়োজন।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ ড্রেজিং না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদে প্রতিনিয়ত বর্জ্য পড়ে আর বর্ষায় পলি জমে তলদেশ ভরাট হওয়ায় হ্রদ নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হ্রদের ছয়টি পয়েন্টে ড্রেজিং করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এই সংক্রান্ত ব্যাপারে উপর মহল থেকে কোন সুরাহা আসলে দ্রুত কাপ্তাই হ্রদে ড্রেজিং করা হবে।
উল্লেখ, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার পরে হ্রদের সৃষ্টি হয়। কাপ্তাই হ্রদে কোন জোয়ার ভাঁটা নেই। বদ্ধ জলরাশি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ হ্রদ এটি। এর আয়তন ৭২৫ বর্গকিলোমিটার। কাপ্তাই হ্রদ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মাছ আহরণ করে জেলেরা। এ মাছের রাজস্ব আদায় করেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোারেশন (বিএফডিসি)। কাপ্তাই হ্রদের মাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা হয়। হ্রদে প্রতি বছর ৬-৭ মাস জেলার ৬ উপজেলায় যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে।