খোদেজা বেগম নড়াইল শহরের ভওয়াখালী এলাকার বাসিন্দা। ১৯৯৮ সালে বিধবা হয়েছেন। যখন তার স্বামী মারা যান, তখন বড় ছেলের বয়স ১২ বছর। ছোট সন্তান প্রায় আট বছরের। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারে হাল ধরার মতো কেউ ছিল না তার। প্রথমে ব্র্যাকের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে ৫০০ বেতনে চাকরি করতেন। এরপর ২০০৬ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের চাকরি নেন। প্রথম দিকে এখান থেকে সম্মানী পেতেন ১২০০ টাকা। সবশেষ পেয়েছেন পাঁচ হাজার টাকা। চাকরির শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছর সুষ্ঠু-সুন্দর ভাবে কেন্দ্র পরিচালনা করে আসলেও খোদেজা বেগমকে বয়স বিবেচনায় হঠাৎ করে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। যদিও ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিয়মানুযায়ী ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে পারবেন তিনি। এখন তার বয়স ৬১ বছরের কাছাকাছি। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে চাকরি ফিরে পাওয়ার আকুতি করেন খোদেজা বেগম।
একই অবস্থা আরেক বিধবা নারী নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মাকড়াইল খানপাড়া কেন্দ্রের শিক্ষক সানজিদা খানমের। তিনি বলেন, আমি অসহায় বিধবা। এই চাকরি আমার সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে আমি তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে কোনো রকম সংসার চালাই। হঠাৎ একদিন সকাল সাড়ে ৭টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে পরিদর্শনে গিয়ে কোনো ছাত্রছাত্রী না দেখে আমাকে বিনা নোটিশে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ আমার কেন্দ্রে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা সকাল সাড়ে ৯টায়। তাহলে এত সকালে কীভাবে ছাত্রছাত্রী দেখতে পাবে ? চাকরিচ্যুত করায় আমি মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমি অসহায় বিধবা নারী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমার চাকরিটা ফিরিয়ে দিন।
একই ভাবে নড়াইল জজকোর্ট মসজিদের সাবেক ইমাম হাফেজ মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামানকে বিনা কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমন হয়রানির শিকার শুধু খোদেজা বেগম, সানজিদা খানম ও মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামানই নন। নড়াইলে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের এমন ভুক্তভোগী শিক্ষকের সংখ্যা ৪৫জন।
নড়াইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান ও ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের এমন অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। এভাবেই জেলার ৪৮২টি মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরণের হয়রানি করা হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্কের উৎকোচ না দেওয়ার কারণে গত এক বছরে ৪৫জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যেসব কেন্দ্রের শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সেইসব শুন্য পদের বিপরীতে অর্থের বিনিময়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষকদের লিখিত অভিযোগে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নড়াইলে বেশ সুনামের সাথে চলে আসছে। ২০২৩ সালের ১ মার্চ বর্তমান উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান যোগদানের পর থেকে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম শুরু হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষকদের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে বিভিন্ন অঙ্কের ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে। ঘুষ দিতে না পারায় ৪৫জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এদিকে, শুন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান এবং ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমানসহ অফিস সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। নিয়োগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিস থেকে সম্প্রতি ০১৯১৪-৬৬৭৮২৬ এই মোবাইল ফোন নাম্বারে দেড় লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। যার কলরেকর্ড ভুক্তভোগীর কাছে সংরক্ষিত আছে।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বাবরা মধ্যপাড়ার সোনিয়া পারভীন বলেন, প্রায় আট মাসে আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন অফিস থেকে আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। আমি নিয়মিত কেন্দ্র পরিচালনা করলেও ঘুষের ৩০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে সম্মানির পাঁচ হাজার টাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সোনিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের ‘ঘুষ দিলে চাকরি থাকে, না দিলে থাকে না’।
ভুক্তভেভাগী শহরের ভওয়াখালী এলাকার খোদেজা বেগম বলেন, আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে সাদা কাগজে সই (স্বাক্ষর) নিয়েছে। সরল বিশ্বাসে সই করেছি। সই করা সাদা কাগজে ওদের (অফিস কর্তৃপক্ষ) সুবিধা মতো কিছু একটা লিখে নিয়েছে। পরে জানতে পারি, বয়স বেশি দেখিয়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে শুধু শিক্ষকদের কাছ ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ নয়! তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ। ২০২৩ সালে ৪৮২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে জাকাতের কথা বলে জোরপূর্বক জনপ্রতি এক হাজার টাকা করে মোট ৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। একই কথা বলে চলতি (২০২৪) বছরে নেয়া হয়েছে জনপ্রতি দুই হাজার টাকা করে। এক্ষেত্রে মোট টাকার পরিমাণ নয় লাখ ৬৪ হাজার টাকা। ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ সমাজ থেকে আমরাই জাকাত পাওয়ার যোগ্য। অথচ আমাদের কাছ থেকে জাকাতের নামে বর্তমান উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের সময়ে অবৈধ টাকা তোলা হয়েছে। বিগত উপ-পরিচালকদের সময়ে এমন ঘটনার নজির নেই।
অপরদিকে, ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর ইমাম সম্মেলনে নড়াইল থেকে ৫০০ ইমাম ঢাকায় যোগদান করায় সম্মানী বাবদ প্রত্যেক ইমামকে এক হাজার ২০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও তাদের কোনো টাকাই দেয়া হয়নি।
বিভিন্ন এলাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে জনসচেতনতামূলক উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও শিক্ষকদের কোনো সম্মানী দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে নড়াইল সদরের কমলাপুর কেন্দ্রের শিক্ষক মাওলানা ক্বারি ইদ্রীস আলী বলেন, আমার উঠান বৈঠকে ৪০ জনের বেশি উপস্থিত ছিল। আমাকে সম্মানী বাবদ ১৫০০ টাকা দেয়ার কথা থাকলেও আমি আজও কোনো টাকা পাইনি। এভাবে উঠান বৈঠকের টাকা অন্য শিক্ষকদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমানের কাছে টাকা চাইলে তিনি বলেন, আমি টাকা কাকে দেব না দেব, সেটা আমার বিষয়। এই টাকার ভাগ উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে দেয়া লাগে। অভিযোগ করে কোনো লাভ হবে না। ভুক্তভোগী শিক্ষক ক্বারি ইদ্রীস আলী ঘটনটি উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানকে জানালে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি দেখছি।
অভিযোগের বিষয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার ফাইজার রহমান বলেন, চাকরির জন্য কারোর কাছে কোনো প্রকার টাকা দাবি করিনি। ঊঠান বৈঠকের টাকাও আত্মসাতের প্রশ্ন উঠে না। কারোর চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।
এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা ঠিক নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার একার কোনো হাত নেই। অফিসিয়াল নিয়মানুযায়ী চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ইমাম সম্মেলনে ইমামদের সম্মানীর টাকা যাতায়াত ও খাওয়া খরচ বাবদ ব্যয় করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে জাকাত বাবদ ২০২৩ সালে এক হাজার এবং ২০২৪ সালে দুই হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।