বৈশাখ মাসে এবার বৃষ্টি নেই বর্ষা কবে আসবে তার কোন নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। বৈশাখ মাস ও শেষে দিকে চোলে যাচ্ছে অথচ বর্ষায় মাছ ধরার যে আনন্দ তা এবার কালীগঞ্জ উপজেলার কোন গ্রাম এলাকায় দেখা মিলছে না। যে কারণে উচ্ছাসের ভাঁটা পড়েছে মাছ ধরা মানুষের। একসময় বর্ষার আগে গ্রামের কৃষক নিজ উদ্যোগে বাঁশ ও বাঁশের বাতা,কাঠি দিয়ে মাছ ধরার যে খাঁচা (ফাঁদ) বানাত তাতেও ভাটা। তবে অন্য এলাকায় মাছের খাঁচা এবং ভিন্ন নাম থাকতে পারে ও আছে। ছোট ও মাঝারি বাঁশ,বাঁশের বাতা ও বাঁশের কাঠিতে নির্মিত লাবানি দেখতে চৌকোনা লম্বা খাঁচার মতো। লম্বার তুলনায় প্রস্থ কম। লাবানির একদিকে বিশেষ ধরনের ছোট গেট থাকে। নদী ও জলাশয়ে ¯্রােতের অনুকূলে সন্ধ্যায় একাধিক লাবানি বসিয়ে পরদিন সকালে গিয়ে দেখা যাবে ছোট মাছ আটকে আছে। ¯্রােতের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সময় মাছগুলো বুঝতেই পারে না কখন গেটের ভেতরে প্রবেশ করে আটকা পড়েছে। তখন বের হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
পরিবেশ বান্ধব এ উপাদানটি কাঁচামালের অভাব ও প্রতিযোগিতায় বাজারে এখন অস্তিত্ব সংকটে। মাছ শিকারের যে কয়টি উপকরণ খুদে পোনা নিধনসহ অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত তার মধ্যে লাবানি,বেনে, ঠিঙ্গে অন্যতম। আটকেপড়া মাছ জীবিত থাকায় শিকারি কিংবা ক্রেতাদের কাছে এর চাহিদাও বেশ। এবার বর্ষা নেই তাই মাছ ধরার বিভিন্ন যন্ত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রেতারা প্রতি শুক্রবার ও শনিবার এই হাটের দির বিক্রির আশায় আনলে ও কোন ক্রেতা মিলছে না।কয়েক বছর যাবত বাঁশের অভাব,মাছ শিকারের আধুনিক যন্ত্রের প্রভাব ও অবৈধ জালের ব্যবহারের কারণে অনেকটাই কোণঠাসা মাছ ধরার এসব যন্ত্র। মূলধন সংকটে কাঁচামাল মজুত করতে না পারায় চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে পারে না বলে জানান কারিগররা।কুটির শিল্পের মর্যাদা পেলেও কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পান না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।স্বল্প সুদে ঋণসহ সরকারি সহযোগিতার দাবি তাদের। এদিকে,শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।কালীগঞ্জ উপজেলায় একসময় কয়েকটি পরিবার লাবানি,ঠিলে,বেনে তৈরির কাজ করলেও সে সব পরিবার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। বাজারে এখন যাবিক্রি হয় তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি দরে ক্রয় করে এনে বিক্রি করে। কিন্তু এসব যন্ত্র চৈত্র মাসে ক্রয় করে মজুত করে রাথে, তারা মনে করে বৈশাখ মাসে বৃষ্টি হবে গ্রাম এলাকার মানুষ মাছ ধরবে এ আশায় তারা এসব ক্রয় করেছে। কিন্তু এ বছর বৃষ্টির কোন নমুনা নেই ফলে মাছ :রার যে আনন্দ সেটা চোখে মিলছে না।কালীগঞ্জ উপজেলার ১১ টি ইউনিয়নে একসময় নদী,খাল,বিল, ডোবায় বেনে, পলই, ছিপ, ছোট ও বড় জাল, লাবানি যন্ত্র দিয়ে মাছ ধোরতো। বর্ষায় বৃষ্টিতে এইসব ফাঁদ নিয়ে নদী ও জলাশয়ে যায়নি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। চাষাবাদের মতো মাছ ধরার এই উপকরণ গুলো ছিল আবশ্যক। বৃষ্টি ও বর্ষার সঙ্গে মাছ ধরা পরিপূরক। এই ফাঁদ গ্রামের সাধারণ কৃষকের ঘরে মাছের ঘাটতি অনেকটা মিটিয়ে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এনে দিত। গ্রামের মানুষের রোগবালাই বেশি থাকত না মাছের প্রোটিন ও ভিটামিনের কারণে। পুষ্টি বিজ্ঞানীগণের মতে বড় মাছের চেয়ে ছোট মাছের পুষ্টিগুণ বেশি। গ্রামে বড় জাল ছাড়া গৃহস্থালি উপকরণে ছোট মাছ ধরা যায় বেশি। আলু বেগুন দিয়ে ছোট মাছের তরকারি চর্চরির স্বাদ আলাদা। তবে এই মাছ ধরে আনার পর গাঁয়ের বধূদের মুখ প্রথমে বেজার দেখা যায় মাছ কুটার বিরক্তিতে। পরে অবশ্য রান্নার সুস্বাদে বিরক্তি মিলিয়ে যায়।
বর্ষা মানেই খাল-বিলে থৈ থৈ পানি, নদী-নালা খাল-বিল নতুন পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যাওয়া। আর নতুন পানিতে ছুটে আসে নানা প্রজাতির মাছ। তাই গ্রামাঞ্চলে নানা কৌশলে মাছ ধরা হয়। বাঁশ দিয়ে তৈরি বিবিন্ন ধরনের মাছ ধরার যন্ত্র/ফাঁদ তৈরি এবং কেনা-বেচায় ধুম যায় বর্ষাকালে কালীগঞ্জ শহরে। মাছ ধরার অপেক্ষাকৃত সহজ কৌশল হল মাছ চলাচলের পথে এ ফাঁদ পেতে রাখা। দেশীয় মাছের স্বাদ নিতে নদী,খালে, বিলে এবং উম্মুক্ত জলাশয়ে এ ফাঁদ পেতে মাছ ধরেন সকল শ্রেনী-পেশার মানুষ। তাই এখানকার হাট-বাজারগুলোতে এখন মাছ ধরার ফাঁদ কেনা-বেচার নেই। যন্ত্র তৈরিকারি সুবল দাস জানান. একটি বড় বাঁশের দাম পড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। ধারালো দা দিয়ে বাঁশের শলাকা তৈরি করা হয়, প্রতিটি শলাকা বা কাঠি নিখুঁত ভাবে বুনন করে বেত সুতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় মাছের ফাঁদ। বাঁশ কেটে,শলাকা তৈরি করে একজন মানুষের পক্ষে দিনে ২/৩টি তৈরি করা সম্ভব। এসব যন্ত্র গুলো ব্যবহার করে চিংড়ি,পুঁটি,চান্দা,টাকি,খৈলশা,বাইম,শিং,টেংরা, ছোট টাকি প্রবৃতি মাছ ধরা পড়ে। এতে করে গ্রাম এলাকার মানুষের বাজার থেকে মাছ কিনতে হয় না।
বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলায় মাছ ধরার ষড়ঞ্জাম তৈরির কারিগররা আর মাছ ধরার ষড়ঞ্জাম তৈরি না করে কিনে বিক্রি করা শুরু করেছে। ষড়ঞ্জাম তৈরিতে খরচ বেশি পড়ায় তারা এখন কিনে বেচা শুরু করেছেন। চলতি বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় নদ-নদী,খাল বিল পানি শূন্য। নেই কোন ¯্রােতধারা। ফলে বাজারে মাছ ধরার জন্য দেশিয় পদ্ধতিতে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার ষড়ঞ্জাম বিক্রয়ে নেই সাড়া।কালীগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী সুকুমার বাবু বলেন,তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাজারে এই ব্যবসা করে আসছেন। তিনি বলেন, আগে বর্ষার শুরুতে আকাশের পানিতে নদ-নদী,খাল বিলে পানি থৈ থৈ করত। আর ¯্রােতের বিপরীতে দেশিয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ দেখা যেত। বাজারে দেশিয় তৈরী এসব যন্ত্র কেনার ধুম পড়ে যেত। হাটবারের দিন ছাড়া বাড়ি গিয়ে কিনে নিয়ে আসত।তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ভাবে এসব ফাঁদ ও যন্ত্র তৈরি হলেও বাঁশ, সুতাসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়াই এগুলো আর তৈরি হয় না। এখন বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারী দরে কিনে এনে বিক্রি করে। লাভ সীমিত হলেও দীর্ঘ দিনের পেশা ছাড়তে পারেননি।দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই ব্যবসা করেন,এবার আবহাওয়া ও মূল্যের কারণে বিক্রি নেই। বিক্রেতারা জানান,মাছ ধরার এসব দেশি যন্ত্রের এলাকা ভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে এবং খুচরা বিক্রিও আলাদা আলাদা।