দ্বিতীয় দফায় শ্রমিকদের দুইপক্ষ ও মাহেন্দ্রা শ্রমিকদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে আবারও রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা। এ সময় টার্মিনাল এলাকায় থাকা প্রায় অর্ধশতাধিক মাহেন্দ্রা, চারটি বাস, সিএনজি ও অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়েছে। শনিবার দিবাগত রাতে ত্রিমুখী সংঘর্ষে কমপক্ষে ৩০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন।
এরমধ্যে ২৬ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পুলিশ টিয়ার সেল নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি একজনকে আটক করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশের সাথে র্যাব ও ডিবি পুলিশের সদস্যরা ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন। এর আগে দিনভর অভ্যন্তরীন রুটের বাস চলাচল বন্ধ ছিলো। এরমধ্যে রাত আটটার দিকে পূর্ণরায় দ্বিতীয় দফায় সংঘটিত ত্রিমুখী হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনার পর পরই বন্ধ হয়ে যায় দুরপাল্লার সব বাস চলাচল। মহসড়ক অবরোধ করে রাখায় অন্যান্য যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে চরম ভোগান্তিতে পরেন অভ্যন্তরীণ ছয় জেলার ১৩টি রুটের যাত্রীরা।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক ও বর্তমান সিটি মেয়রের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায়ই অচল করে হয়ে যায় টার্মিনাল এলাকা। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। যেকারণে জনদুর্ভোগ ও যাত্রীদের জিম্মি করা থেকে মুক্ত রাখতে বাস টার্মিনাল এলাকাকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাখাসহ বাস শ্রমিক কিংবা মালিক ছাড়া অন্য নেতাদের বাস টার্মিনাল থেকে দূরে রাখার দাবী করেছেন সচেতন বরিশালবাসী।
থ্রি-হুইলার চালক সোহেল রানা বলেন, বাস শ্রমিকদের দুইটি পক্ষ নিজেরা মারামারি করে বাস বন্ধ করেছে। এরপর আমরা পাবলিক সার্ভিস দিয়ে আসছিলাম। এজন্য ক্ষিপ্ত হয়ে বাস শ্রমিকদের ওই দুই গ্রুপের লোকজনেই আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারা প্রায় অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলা, সিএনজি ও অটোরিকসা ভাঙচুর করেছে। গৌতম রায় নামের আরেক থ্রি-হুইলার চালক বলেন, অহেতুক বাস শ্রমিকরা এসে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। দুইদল বাস শ্রমিকরা তারা গাড়ি ভাঙচুর করে শ্রমিকদের মারধর করেছে। এ সময় পুলিশ তাদের কিছু না বলে উল্টো থ্রি-হুইলার চালক ও শ্রমিকদের পিটিয়েছে। এতে তাদের বেশকিছু শ্রমিক আহত হয়েছেন। উভয়গ্রুপের গুরুত্বর আহত ২৬ জনকে শেবাচিমসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। গৌতম রায় আরও বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে নথুল্লাবাদ থেকে সাতটি রুটে থ্রি-হুইলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। আমাদের ক্ষতিপূরণ না পেলে গাড়ি চালানো বন্ধ রাখাসহ কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
বাস শ্রমিকরা জানিয়েছেন, মাহিন্দ্রা শ্রমিকরা আকস্মিক তাদের ওপর সন্ধ্যার পর হামলা চালায়। যা প্রতিহত করতে গেলে টার্মিনাল সংলগ্ন এলাকায় থাকা বাসগুলো ভাঙচুর করেছে মাহিন্দ্রা শ্রমিকরা। জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কাজী কবির বলেন, সন্ধ্যার দিকে দুপুরের ঘটনার সমাধান করে বাস চলাচলের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ সময় আবার বাস ও থ্রি হুইলার শ্রমিকদের মধ্যে ঝামেলায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এয়ারপোর্ট থানার পরিদর্শক লোকমান হোসেন জানান, সন্ধ্যার পর বাস ও থ্রি-হুইলার শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে থ্রি-হুইলার ও বাস ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে তারা এক রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করেছেন। রাতে নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছাড়েনি। তবে ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর থেকে এসে দীর্ঘসময় আটকে পরে। এতে করে নগরীর বৈদ্যপাড়ার প্রবেশ মুখ থেকে আমতলার মোড় পর্যন্ত সড়কে বিপুল সংখ্যক যানবাহন আটকা পরে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। পরবর্তীতে রাত সাড়ে দশটার দিকে পুলিশের হস্তক্ষেপে যাত্রীবাহী বাসসহ সকল যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার আলী আশরাফ ভুঞা জানান, জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কমিটি নিয়ে শনিবার দুপুরে দুইপক্ষের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। এরপর সন্ধ্যার পর বাস ও থ্রি-হুইলার শ্রমিকদের মধ্যে ফের সংঘর্ষ বাঁধে।
জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি অসীম দেওয়ান বলেন, শ্রমিকদের একটি গ্রুপ প্ররোচনা দিয়ে ঝামেলা সৃষ্টি করছে। তাই রাতেও বাস চলাচল শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে রোববার সকাল থেকে বাস চলাচল শুরু করেছে।
ঘটনার সূত্রপাত: শনিবার দুপুরে মাদারীপুরগামী একটি বাস যাত্রী নিয়ে নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। ওইসময় একটি মোটরসাইকেল বাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সাইড নেওয়ার জন্য বাসের চালক হর্ণ বাজায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোটরসাইকেল আরোহী নুরুল ইসলাম বাবাই নামের এক নেতা ও তার সহযোগি বাসের চালক সাকিল হোসেনকে মারধর করে। এ সময় চালককে রক্ষা করতে সৌরভ নামের আরেকজন বাস শ্রমিক এগিয়ে আসলে তাকেও মারধর করা হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে টার্মিনালের সামনে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন। পাশাপাশি টার্মিনালের ভেতরের আসবাসপত্র ভাঙচুর করে। পরবর্তীতে দীর্ঘ আলোচনা শেষে সমঝোতার আশ্বাসে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিত স্বাভাবিক হলেও সন্ধ্যার পর তা পুনরায় রণক্ষেত্রে পরিনত হয়।
দুপুরের ঘটনায় আহতরা জানিয়েছেন, যে বহিরাগতরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নবনির্বাচিত সভাপতি কাজী কবিরের ঘনিষ্টজন। কবিরের লোকজন বেশ কিছুদিন ধরে নথুল্লাবাদ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারা আরও জানান, এখানে পাল্টাপাল্টি কমিটি থাকলেও উভয় কমিটিরই টার্মিনাল এলাকায় বর্তমানে সেবামূলক কোনো কার্যক্রম নেই। অভিযোগ অস্বীকার করে কাজী কবির বলেন, তৃতীয় পক্ষ উস্কানি দিয়ে সামান্য ঘটনাকে সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ফারুক হোসেন জানান, শ্রমিক ইউনিয়নের দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলে আসছে। এনিয়ে এর আগেও দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।