ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও নাসিরনগরের ৬ষ্ট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হতাশার ভোটার উপস্থিতি ভাবিয়েছে প্রার্থীদের। গতকাল সকাল ৮টায় ভোট শুরূ হলেও প্রথম ভোট পড়ে সাড়ে ৮টায়। সোয়া ঘন্টা পর সরাইল অন্নদা স্কুল কেন্দ্রে কাস্ট হয় ৩ পারসেন্ট ভোট। কপালে ভাজ পড়ে যায় প্রার্থীদের। বেলা বাড়ার সাথে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধির আশায় বুক বাঁধেন প্রার্থীরা।
কিন্তু না। গত কয়েকটি নির্বাচনের হতাশাজনক ভোটার উপস্থিতি কোন ভাবেই পিছু ছাড়েনি দুই উপজেলায়। ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিজাইডিং, পোলিং, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা অলস সময় অতিবাহিত করেছেন। অনেককে কেন্দ্রে বসে ঘুমিয়ে সিগারেট টেনে সময় কাটাতে দেখা গেছে। বেলা বৃদ্ধির সাথে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোটের ছড়াছড়ি শুরূ হয়ে যায়। জাল ভোট ও ভোটারকে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার প্ররোচনাকালে ধরা পড়ায় পোলিং সহ ৫ জনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমান আদালত। একসময় প্রার্থীর সাথে প্রার্থীর বিবাদ বাঁধে। ২/১ টি কেন্দ্রে শিশুদেরকেও ভোট দিতে দেখা যায়। বড় ধরণের কোন সংঘাত সংঘর্ষ ছাড়া দুই উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হলেও চুড়ান্ত পর্যায়ে ভোট কাস্ট হয়েছে মাত্র ২৫ পারসেন্ট।
সরজমিন অনুসন্ধান ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের দপ্তর সূত্র জানায়, সকাল ৮টা ভোট গ্রহন শুরূ হয়। সরাইল অন্নদা সরকারী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রথম ভোট পড়ে আধা ঘন্টা পর সাড়ে ৮টায়। ৯ টায় দেখা যায় ওই কেন্দ্রটি একেবারেই ফাঁকা। ৭ নম্বর কক্ষে ভোট কাস্ট হয় মাত্র ৩টি। আর ৬ নম্বর কক্ষে ৫টি ও ৮ নম্বর কক্ষে ৬টি। সোয়া ১ ঘন্টায় সরাইল সদরের ৩৫৭৮ জন ভোটারের এ কেন্দ্রে মোট কাস্ট হয় ১২১টি ভোট। ভোটারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। সকাল ১০ টায় সরাইল উপজেলা চত্বরের ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রে কাস্ট হয় ১০ পারসেন্ট। সকাল ১১টায় কালিকচ্ছ পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ভোটার শুন্য আঙিনা খাঁ খাঁ করছে। নিজ দপ্তরে বসে জিমুচ্ছেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। বসে বসে অলস সময় অতিবাহিত করছেন নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিতরা। বারান্দার টেবিলে বসে ঘুমুচ্ছেন মহিলা আনসার সদস্য। কাস্টিং ভোটের পারসেন্টিজ মাত্র ৯। একই চিত্র এম এ বাশার আইডিয়াল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রেও। সেখানকার ৭ নম্বর কক্ষে দেখা যায় এক শিশু ভোট দিতে হাতে কালি লাগানোর কাজে ব্যস্ত। কোন ক্লাশে পড়ছ? জিজ্ঞেস করার সাথেই বলে ওঠে না আমি পড়ি না। আমি কাজ করি। এ কেন্দ্রেও দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ভোট কাস্ট হয়েছে ১৯ পারসেন্ট। অর্থাৎ ৩১২২ ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ৫৭৭ টি ভোট। একই সময়ে গলানিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ২৭৮৩ ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ৬৭০ ভোট। যার পার্সেন্টেজ ২৪। বিকাল ২টায় শাহবাজপুর বহুমূখী উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ৪৯২৬ ভোটের মধ্যে কাস্ট হয়েছে ১২০০ ভোট। শতকরা হার ২৪ ভাগ। শেষ পর্যন্ত দুই উপজেলার ১৭৭ টি কেন্দ্রে গড়ে ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৭ পারসেন্ট ভোট কাস্ট হয়েছে। প্রার্থীরা কখনো এত অল্প পারসেন্ট ভোট কাস্ট হবে কল্পনাও করেননি। তাদের প্রত্যাশা ছিল কমপক্ষে ৫০ ভাগ ভোট কাস্ট হবে। বেলা দেড়টা দিকে কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে প্রার্থী ও সমর্থকরা। টিঘর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে চেয়ারম্যান প্রার্থী শের আলম ও কাপণ্ডপিরিচ এর এজেন্টের মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। প্রশাসনের তড়িৎ হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। বেলা ২টার দিকে নাসিরনগরের চাতলপাড় ইউনিয়নের রতনপুর কেন্দ্রে ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হুমায়ুন ও কামরূল হুদার মধ্যে বিবাদ হয়। এ সময় কর্তৃপক্ষ ওই কেন্দ্রের ভোট গ্রহন কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখেন। বেলা ২টার সরাইলের কয়েকটি কেন্দ্রে জাল ভোটের ছড়াছড়ি শুরূ হয়। প্রশাসনের সতর্ক অবস্থানের কারণে সুবিধা করতে পারেনি তারা। নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ৩২ নম্বর কেন্দ্র কাটানিসার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের গোপন কক্ষে গিয়ে অন্যের ব্যালট পেপার হাতে নিয়ে অবৈধভাবে সিল মারার সময় শাকির মিয়া (৩৯) নামের এক ব্যক্তিকে হাতেনাতে আটক করে ফেলে। একই কেন্দ্রের পোলিং এজেন্ট মো. হৃদয় মিয়া (২৮) মো. রাকিব হোসেন (২৪) ভোটারদের একটি নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য অন্যায় ভাবে প্ররোচিত করার সময় ধরা পড়ে। এজন্য ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট শাকিরকে ১৫ দিন, হৃদয়কে ১০ দিন ও রাকিব হোসেনকে ৭দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছেন। বিকাল ৩টার দিকে সরাইল সদরের অন্নদা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে অবৈধ পন্থায় জাল ভোট দেয়ার সময় হাতেনাতে আটক তামিম মিয়াকে (২৬) ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন নবীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট তানভীর ফরহাদ শামীম। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে পানিশ্বর উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে জাল দেয়ার সময় আটক হয় মোহাম্মদ মিয়ার ছেলে ইমরান (১৮)। নিজের দোষ স্বীকার করায় ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মো. শরিফ নেওয়াজ ইমরানকে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া শান্তিপূর্ণ ভাবেই দুই উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। একাধিক ভোটার বলেন, এখন নির্বাচনে টাকার ছড়াছড়ি হয়। যা সমাজের সচেতন ভদ্র ও নিরীহ লোকজন পছন্দ করেন না। তাই মনের ক্ষোভে অনেক সচেতন নারী পুরূষ ভোট কেন্দ্রে আসেন না। এ ছাড়াও দুই উপজেলায়ই বর্তমানে ইরি-বোরো ধান কাটা ও ঘরে তোলার কাজে অধিকাংশ নারী পুরূষ খুবই ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর বুধবার হওয়াতে সরকারী বেসরকারী চাকরিজীবীরা ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসতে পারেননি। এসব কারণেও ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক হতে পারে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৭৭ টি কেন্দ্রের ভোট গণণা চলছিল। চুড়ান্ত ফলাফল পরে পাওয়া যাবে। সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবা উল আলম ভূঁইয়া ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. সাদেকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আনসারসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে দুই উপজেলার ১৭৭টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহন সম্পন্ন করতে পেরেছি। সেই সাথে অপরাধীদের বিরূদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহন করেছি।