জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলা বৃটিশ শাসনামল থেকেই নানা রকম বছর বিপ্লব ও আন্দোলনের উর্বরভূমি হিসাবে পরিচিত। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর বিচরণ ক্ষেত্র পাঁচবিবি উপজেলা বহু রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের স্বাক্ষী হয়ে আছে। তেভাগা আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, বৃটিশ ক্ষেদাও আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ, সর্বপরি ২০১৩ সালে মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বহু মানুষ রক্ত দিয়ে পাঁচবিবির নাম অম্লান করে রেখেছে। অতীত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মহান জুলাই বিপ্লবেও পাঁচবিবির ছাত্র ও যুবসমাজ সম্মুখ সারিতে ছিল। জুলাই বিপ্লব তথা বৈষ্যম্য বিরোধী আন্দোলন সফল করতে গিয়ে, পুলিশের গুলিতে জয়পুরহাটে সর্বপ্রথম শহীদ হন পাঁচবিবির বিশাল নামে এক অকুতোভয় যুবক। ২০ বছরের টগবগে যুবক নজিবুল সরকার ওরফে বিশাল দিনমজুরের ঘরে জন্ম নিলেও তার হৃদয়টা ছিল নামের মতই বিশাল ও নরম। মেধাবী ছাত্র বিশাল অর্থের অভাবে ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পেরে, ভর্তি হয়েছিল পাঁচবিবির নাকুরগাছি কারিগরি কলেজে। পড়ালেখার পাশাপাশি বাড়িতে বাবামার কাজে সাহায্য করত এবং ছাগল পালন করতো। ১০ম শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র ছোট ভাই মোমিনকে উৎসাহ দিয়ে বলত, তুই চিন্তা করিসনা ভাই, তোর লেখা পড়ার খরচ যোগানোর দায়িত্ব আমার। আমার হয়ত পড়ালেখা আর হবে না। আমরা গরীব, উপরন্ত বাবা বৃদ্ধ হয়েছে, সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হবে, কিন্তু তুই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর। তোকে বড় হতে হবে, আমার স্বাপ্ন তোকেই পূরন করতে হবে ! চোখের পানি মুছতে মুছতে বিশালের মা বুলবুলী খাতুন বিশালের স্বপ্নের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন, একপর্যায়ে হুঁহুঁ করে কেঁদে উঠে বুলবুলী খাতুন বলে উঠলেন” খুনি হাসিনা আমার ছেলেটারে বাঁচতে দিলনা বাবা, গুলি করে মারে ফেললো। আল্লাহ যেন খুনি হাসিনার বিচার করে। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার অন্তর্গত ধরঞ্জি ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামে বিশারের জন্ম।পিতা মজিদুল সরকার ও মা বুলবুলী খাতুনের বড় ছেলে বিশাল কারিগরি কলেজে এইচ এসসিতে পড়ত। অত্যন্ত মেধাবী ও সুদর্শন চেহারার বিশাল গ্রামের সবার প্রিয়পাত্র ছিল। ছোট ছেলে মোমিন পার্শবর্তী রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণিতে পড়ে। বৃদ্ধ পিতা মজিদুল সরকার দিনমজুরের কাজ করতেন। মা বুলবুলী খাতুন সংসারের কাজের পাশাপাশি ছাগল, হাঁস, মুরগী পালন করে অভাবের সংসারে সাপোর্ট দেওয়ার পাশাপাশি ছেলে দুটোর পড়ালেখার খরচ চালাতেন। বুলবুলী খাতুন চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার ছেলেটারে গ্রামের সবাই ভালবাসত আদর করত। জুলাই মাসে কলেজে নিয়মিত যেত না ও বলত মা সারা দেশে কোটা বিরোধী আন্দোলন হচ্ছে কলেজে ক্লাস হচ্ছে না, ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই আন্দোলন করছে। আমি বলেছিলাম বাবা তুমি যেন ওসব আন্দোলনে যেওনা। আমরা গরীব মানুষ আমাদের আন্দোলন করার দরকার নাই। ও আমার কথা শোনেনি। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে সকালে বের হয়ে যেত, ফিরত শেষ বেলা। জিজ্ঞেস করলে বলত, বন্ধুরা মিলে ঘুরতে গেছিলাম। পরে জেনেছিলাম ও মিঠিল করতে যেত। ওর বন্ধুরা মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে একসঙ্গে মিছিলে যেত। আমি কিছুই জানতামনা। দীর্ঘস্বাস ফেলে বুলবুলী খাতুন বলেন” আমি একটু যদি জানতে পারতাম, তাহলে বাবাকে (বিশালকে) যেতে দিতামনা। একটু নিরব থেকে বুলবুলী থাতুন আবারও বলতে থাকেন বিশালের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর করুন কাহিনী। সেদিনটি ছিল ৪টা আগষ্ট রোববার। সকাল সকাল ঘুম উঠে ফজরের নামাজ পড়ে, বিশাল ঘরের মধ্যে এটা সেটা করছিল কিন্তু কথাবার্তা তেমন বলছিলনা। সকাল ৯টার দিকে আমাকে বলে, ‘মা’ আমাকে জয়পুরহাটে যেতে হবে তোমার ঔষধটা আনা দরকার।
আমি বললাম বাবা এই গন্ডোগোলের মধ্যে জয়পুরহাট না গেলেই নয়? জয়পুরহাটে এমন কি কাজ আছে তোর; ও কেন জানি জেদ ধরে বলল না মা আমাকে আজ জয়পুরহাট যেতেই হবে, ওরা (বন্ধুরা) সবাই অপেক্ষা করছে, বলে তারাহুরা করে একটু খেয়ে সাড়ে নয়টার দিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় বাড়ির বাইরে ওর ছোট ভাইকে বলে যায় “মোমিন, আমরা দাবি আদায়ের জন্য মিছিলে যাচ্ছিরে এ দাবি সত্য প্রতিষ্ঠার, তুই বাবামার কাছে থাকিস, আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে বাবা মাকে বলিস, তারা যেন ১০টা এতিমকে ডেকে এক সন্ধ্যা খাওয়ায়। কথাগুলো বলতে বলতে বুলবুলী খাতুন ডুকরিয়ে কেঁদে ওঠেন, হায় ওর কথাগুলো যদি আমি আগে জানতাম তাহলে কি আর যেতে দিতাম? আমার মনটা সেদিন কেমন কেমন জানি করছিল। একটুও ভালো লাগছিলনা, বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছি, আমার ছেলেটা (বিশাল) কখন যে ফিরে আসে ? শেষে বিশাল ঠিকই ফিরে এলো কিন্তু এম্বুলেন্সে করে লাস হয়ে। খুনি হাসিনার গুন্ডা বাহিনী আমার বিশালকে পাখির মত গুলি করে মেরেছে। একটু শান্ত হয়ে বুলবুলী খাতুন আবারও বলতে থাকেন (এসময় বিশালের বাবা পাশে বসে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছিল) বুলবুলী খাতুন কথা বলতে থাকেন” বিশাল ও তার বন্ধুরা প্রায় অর্ধশত যুবক রতনপুর থেকে ভটভটি যোগে জয়পুরহাট যায় মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য। বিশালের বন্ধুদের ভাষ্য অনুযায়ী” বিশাল খুব সাহসী ছিল, ও মিছিলের সামনে থাকতে পছন্দ করত। ৪ আগষ্টের সরকার বিরোধী গণমিছিলে বিশাল সামনে থেকে স্লোগান দিচ্ছিল। জয়পুরহাট শহরের মেইন সড়কে পুলিশ মিছিলে বাঁধা দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়। একসময় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পরে গোটা শহরে। পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, এলোপাথারী গুলি সমানে চলতে থাকে; এক পর্যায়ে পুলিশের ছোড়া ১টা গুলি সরাসরি বিশালে ডান পাজরে ঢুকে বাম পাজর দিয়ে কলিজার অংশবিশেষ সহ বের হয়ে যায়। বিশাল মাটিতে লুটিয়ে পরে। ওর বন্ধুরা ধরাধরি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায় কিন্তু ডাক্তার চিকিৎসা দেওয়ার পূর্বেই বিশালের দেহ নিথর হয়ে যায়। ডাক্তাররা শুধু মৃত্যু ঘোষনা করে। বিশাল মিছিলে যাওয়ার সময়ে তার বন্ধুদেরকে বলেছিল, আমার বাবা মাকে দেখার জন্য ছোট একটা ভাই আছে। কোন সমস্যা নাই প্রয়োজনে শহীদ হব। বিশালের শহীদ হওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। ৪ আগষ্ট রাত ১০ টায় নিজ গ্রামে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ভয় ও উৎকন্ঠার মর্ধ্যওে সহস্রাধীক মানুষ জানাজায় উপস্থিত হয়েছিল। পরিশেষে এই ঘৃন্য হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে বললে বিশালের মা বুলবুলী খাতুন দৃপ্তকন্ঠে বলেন” আমার আরো একটা ছেলে আছে, প্রয়োজনে তাকেও কুরবানি দিব তবুও যেন খুনি শেখ হাসিনাকে আর এ দেশে না দেখি। ওর যেন ফাঁসি হয়। বর্তমান সরকারের কাছে আমার এই মনতি। এবিষয়ে বিশালের বাবার নিকট কিছু জানতে চাইলে তিনি আমার দেশকে বলেন” সরকার বিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ অথবা আহত হয়েছে তাদেরকে যেন রাষ্ট্রিয় মর্যাদা দেওযা হয় এবং খুনি হাসিনার যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। তাহলেই আমরা শান্তি পাব। আমার বিশালের আত্মা শান্তি পাবে। আর কিছু চাই না।