বাংলাদেশে মানব পাচার এখন সবচেয়ে বড় আন্তঃসীমান্ত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। গ্লোবাল অর্গানাইজড ক্রাইম ইনডেক্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মানব পাচারের সূচক ১০-এর মধ্যে ৮ পয়েন্টে পৌঁছেছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এই পাচারের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কক্সবাজার উপকূল হয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার দিকে মানব পাচারের প্রবণতা ব্যাপকহারে বেড়েছে। বিশেষ করে টেকনাফ, ইনানী, মহেশখালীসহ বেশ কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল এখন পাচারকারীদের জন্য নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় দালালরা জনপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা নিয়ে পাচারের জন্য লোক সংগ্রহ করে, পরে তাদের মালয়েশিয়ায় বিক্রি করা হয় চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায়। বিদেশে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ অভিবাসনের পথ বেছে নেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো আয় দেশের অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সম্ভাবনাময় এ খাত দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচার সিন্ডিকেটের অপতৎপরতায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে জনশক্তি রফতানির নিরিখে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় গত বছরের ৩১ মে বন্ধ হয়েছে। এর আগেও একই অভিযোগে একাধিকবার তা বন্ধ হয়েছিল। একই অভিযোগে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বড় বড় শ্রমবাজার থেকেও একাধিকবার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। ফলে অনেকেই অবৈধ পথে বিদেশে যেতে তৎপর হয় এবং মানব পাচারের সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছেন অনেকেই। বিগত সময়ে সরকারঘনিষ্ঠরাই মানবপাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে সব সরকারের আমলেই মানব পাচারের সিন্ডিকেট সক্রিয় থেকেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ছোটখাটো মানব পাচারকারী ধরা পড়লেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে মূল অপরাধীরা। এখনো সক্রিয় রয়েছে মানব পাচারের সিন্ডিকেট। সরকারের কঠোর অবস্থান না থাকায় অনেকেই মানব পাচারকে কম ঝুঁকির ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে মানব পাচার প্রতিরোধ করতে না পারার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানব পাচার প্রটোকল-২০০০-এর নির্দেশনা অনুযায়ী পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে মানব পাচারের বিরুদ্ধে কোনো সরকারকেই দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মানব পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর ও সক্রিয় হতে হবে। যাঁরা প্রলোভনে পড়ে বিদেশে কাজের আশায় যান, তাঁদের যথাযথ তথ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।