গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, গুমের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং কালিমা মোচন হবে। তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, গুমের সঙ্গে জড়িতদের ব্যক্তিগত ফৌজদারি দায় রয়েছে, যা পুরো বাহিনীর ওপর বর্তায় না।
মঙ্গলবার (৪ মার্চ) রাজধানীর গুলশানে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কমিশন অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এই তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই কমিশনের মূল লক্ষ্য।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অপরাধীরা অনেক সময় আইনের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের ধর্ম, সম্প্রদায় বা সামাজিক গোষ্ঠীর আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করে। এই প্রবণতাকে বলা হয় ‘আইডেন্টিটি বেজড ডিফেন্স’ বা ‘কমিউনিটি শিল্ডিং’। তবে ফৌজদারি অপরাধ সর্বদাই ব্যক্তিগত দায়ের মধ্যে পড়ে, এতে গোটা বাহিনীকে দায়ী করার সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য গুমের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিশনের অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়। এর মধ্যে ঢাকা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ডিজিএফআই, সিটিটিসি ও র্যাবের নিয়ন্ত্রণাধীন বন্দিশালা রয়েছে। বিশেষ করে, বগুড়া পুলিশ লাইনের ভেতরে গোপন বন্দিশালার অস্তিত্বের বিষয়টি কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘পুলিশ লাইনের ভেতরে কারাগারের মতো গোপন বন্দিশালা তৈরি করে রাখা হয়েছিল, যেখানে বন্দিদের এনে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো।’
গুম তদন্ত কমিশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী, প্রতিটি গুমের ঘটনা তৎকালীন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পরিচালিত হয়েছে। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটি গুমের ঘটনা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে।’ কমিশন জানায়, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত গুমের ঘটনায় সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশ ছিল।
গুম তদন্ত কমিশনে এ পর্যন্ত ১,৭৫২টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১,০০০টি অভিযোগের প্রাথমিক যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। ২৮০ জন অভিযোগকারীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় ৪৫ জন কর্মকর্তার বক্তব্য নেওয়া হয়েছে।
কমিশন জানিয়েছে, ভারত থেকে পুশইন হওয়া ১৪০ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতের কারাগারে আটক থাকার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।