রাজশাহী নগরীতে আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টার কেন্দ্র করে মহিলা দলের এক নেত্রীর বাড়িতে হামলা চলানো হচ্ছে। এমন খবর পেয়ে পুলিশ আসে। কিন্তু পুলিশ এসে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই কিছুটা দূরে পর পর দুটি ককটেল ফাটে। আত্মরক্ষায় পুলিশ তখন গিয়ে পাশের একটি সেলুনে ঢুকে পড়ে। নামিয়ে ফেলা হয় সেলুনের সাটারও। এরপর প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। সন্ধা সাড়ে ৭ টা থেকে সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত কয়েক দফা বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে চলে সংঘর্ষ। গত শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর দড়িখড়বোনা এলাকায় মহানগর মহিলা দলের সহ-ক্রীড়া সম্পাদক লাভলী খাতুনের বাড়িতে প্রথমে হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু পুলিশ এসে সংঘর্ষ থামাতে পারেনি। তারপরও সন্ধা ৭ সাড়ে থেকে সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। সংঘর্ষ শেষ হলে সেনাবাহিনীর পাঁচটি গাড়ি আসে। এ সংঘর্ষে আহত হন চারজন, পুড়িয়ে দেওয়া হয় এক সাংবাদিকের মোটরসাইকেলসহ তিনটি মোটরসাইকেল।মূলত মহিলা দল নেত্রী লাভলী ও নগর যুবদলের সাবেক সদস্য সচিব মারুফ হোসেন জীবনের অনুসারীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মারুফও একই এলাকার বাসিন্দা। পুলিশের নিষ্ক্রিয় থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে নগরীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাক আহমেদ কোনো জবাব দেননি। তিনি বলেছেন, সংঘর্ষের ঘটনায় শনিবার দুপুর পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। কোনো পক্ষ লিখিত অভিযোগ বা মামলা করলে বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে গত ৩০ নগর মহিলা দলের ক্রীড়া সম্পাদক বিথী খাতুন একটি মামলা করেন। বিথী আর লাভলী ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এ মামলায় নগরীর বোয়ালিয়া (পশ্চিম) থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ বাবু ওরফে ব্যাটারি বাবু ও তার ভাই সাব্বির বাবুকে আসামি করা হয়। তারা কাদিরগঞ্জ এলাকার একটি বহুতল ভবনের ফ্ল্যাটে থাকেন। গত বৃহস্পতিবার লাভলী লোকজন নিয়ে ওই ফ্ল্যাট ঘেরাও করেন। পরে যৌথবাহিনী অভিযান চালালে মোস্তাককে পাওয়া যায়নি। তবে গভীর রাতে তার ভাই সাব্বিরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে ধরানো নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। এর জের ধরেই বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে লাভলীর অভিযোগ। তিনি বলেন, সাব্বিরকে তুলে দেওয়ার সময় সেখানে গিয়েছিলেন সাবেক যুবদল নেতা জীবন। তিনি তাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন সাব্বিরকে না ধরানোর জন্য। কিন্তু তিনি শোনেননি। পরে শুক্রবার জীবন তার বাসায় ইফতার এবং পাঁচ লাখ টাকা পাঠান। বিথীকে দিয়ে ওই মামলা থেকে সাব্বির ও মোস্তাককে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু সেই প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দেন। এর জের ধরে তার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। লাভলীর বাড়িতে হামলার পর তার অনুসারীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা দড়িখড়বোনা মোড়ে জীবনের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ইটপাটকেল মারেন। পাশে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের ব্যক্তিগত কার্যালয়ও ভাঙচুর করা হয়। তখন দুপক্ষ লাঠিশোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে দড়িখড়বোনা, উপশহর মোড়, রেলগেট, সপুরা ও শালবাগান এলাকায়। তখন ককটেল ফোটে। এ সময় গুলিরও শব্দ পাওয়া যায়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে সংঘর্ষ থামে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, লাভলীর বাড়িতে হামলার পরই ৭-৮ জন পুলিশ আসে দড়িখড়বোনা মোড়ে। তারা এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। তখন ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ককটেল ফুটলে পুলিশ দড়িখড়বোনা মোড়ের একটি সেলুনে ঢুকে ভেতর থেকে সাটার লাগিয়ে দেয়। এরপর রাত ১১টা পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের আর কোনো ভূমিকাই দেখা যায়নি। সংঘর্ষ থেমে যাওয়ার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের এলাকায় দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে মোটরসাইকেলে দেওয়া আগুন নেভান। এর আগে এই সংঘর্ষের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের নগর বিশেষ শাখার (সিটিএসবি) তোফাজ্জল হোসেন ইটের আঘাতে আহত হন। কানে গুলি লাগে মো. রনি নামের রেলওয়ের এক কর্মচারীর। এছাড়া বাড়িতে হামলায় মহিলা দল নেত্রী লাভলী ও তার আড়াই বছর বয়সী নাতনি লামিয়া আহত হয়। তাদের সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রাতেই লাভলী হাসপাতাল থেকে এসে তার আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। লাভলী দাবি করেছেন, তার বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছে। ভয়ে তিনি বাড়ি যেতে পারছেন না। তার বাড়ির সবকিছু গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুটপাটও চলছে। লাভলী জানান, চিকিৎসা শেষে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি মামলা করবেন। বিষয়টি দলের শীর্ষ নেতাদেরও জানানো হয়েছে। শীর্ষ নেতাদের জানানোর বিষয়টি জানিয়েছেন সাবেক যুবদল নেতা জীবনও। এ নিয়ে তাদের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। তবে লাভলী যেসব অভিযোগ করছেন তা সত্য নয় বলে দাবি জীবনের। আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক ও তার ভাই সাব্বিরকে মামলা থেকে বাদ দিতে লাভলীর বাড়িতে পাঁচ লাখ টাকা পাঠানোর অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাক ও তার ভাই সাব্বিরকে ধরানো নিয়ে ঘটনা নয়। বরং, লাভলীর সঙ্গেই মোস্তাকের ভাল সম্পর্ক। তিনি আরও বলেন, ‘লাভলীর ছেলে লাম নগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌরিদ আল মাসুদ রনির সঙ্গে থাকত। আর তার ভাই নাঈম নগর তাঁতী লীগের সহসভাপতি। তাদের ধরার জন্য ছাত্রদলের ছেলেরা লাভলীর বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু তার বাড়িতে কে হামলা-ভাঙচুর করেছে তা জানি না। আমি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ভোট করব। তাই আমাকে জড়াচ্ছে। গত শুক্রবার দলেরই দুই গ্রুপের মধ্যে এমন সংঘর্ষ নিয়ে জানতে চাইলে নগর বিএনপির সদস্য সচিব মামুনুর রশিদ বলেন, আমি এই ব্যাপারটা বিস্তারিত জানি না। যে মহিলা (লাভলী) সংবাদ সম্মেলন করেছে, তার কথাই সঠিক। যেহেতু দলেরই দুইটা গ্রুপ, আমরা ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখব।