বিজয়ের দুদিন পর সৈয়দপুর শত্রুমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর

এফএনএস (ওবায়দুল ইসলাম; সৈয়দপুর, নীলফামারী) :
| আপডেট: ৫ জানুয়ারী, ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম | প্রকাশ: ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৩:১১ এএম
বিজয়ের দুদিন পর সৈয়দপুর শত্রুমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর

মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশ শত্রুমুক্ত হলেও সৈয়দপুর শহর হানাদারমুক্ত হয় দুদিন পর ১৮ ডিসেম্বর। আবার দুই দিন আগে অর্থাৎ ২৩ মার্চ সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ২৩ মার্চ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর বিহারিরা শহর অবরুদ্ধ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি নিধনে। সে সময় অবরুদ্ধ বাঙালিদের রক্ষা করতে আশপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সৈয়দপুর শহর ঘেরাও করে। এখানে পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে নিহত হন পাশের চিরিরবন্দর উপজেলার (সে সময় থানা) সাতনালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহতাব বেগ। তিনিই এ অঞ্চলের প্রথম শহীদ। পরে নয় মাস যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভারতের হীম কুমারী ক্যাম্প থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী সৈয়দপুর শহর আক্রমণ করলে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর বিহারিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এদিন বিজয়ের আনন্দে চারপাশের গ্রাম থেকে মুক্তিপাগল হাজার হাজার মানুষ সৈয়দপুর শহরে প্রবেশ করে। তারাসহ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ নেতা কাজী ওমর আলী ও অন্য নেতাদের নিয়ে শহরে আনন্দ মিছিল করা হয়। পরে তারা পুরো শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পৌরভবন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান। শহীদ পরিবারের সন্তান মহসীনুল হক মহসীন বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দপুরের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে সৈয়দপুর শহরটি ছিল পুরোপুরি বিহারি নিয়ন্ত্রিত। আর ঐতিহাসিক কারণে এদেশের অধিকাংশ বিহারি ছিল মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে দখলদার পাকিস্তানিদের পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জনপদ থেকে বিহারিরা ১৬ ডিসেম্বরের আগে সৈয়দপুর শহরে চলে আসে। তারা রেলওয়ে স্টেশন ইয়ার্ডের খালি ওয়াগন ও শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যেখানে ফাঁকা জায়গা পেয়েছে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে। এসব কারণে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে পুরো ১৯৭২ সাল বাঙালিরা সৈয়দপুর শহরে ঢুকতে পারেনি। তখন আশপাশের বিভিন্ন জনপদ থেকে বাঙালিরা সৈয়দপুর শহরে এসে সারাদিন প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যা হলেই আবার শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতেন। বিহারিরা সৈয়দপুর শহরে অবরুদ্ধ থাকলেও তারা ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার ৮ দিন পর ২৪ ডিসেম্বর স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে সভা চলাকালে গ্রেনেট হামলায় গুরুতর আহত হন আওয়ামী লীগ নেতা ডা.মোবারক আলী এবং ঘটনাস্থলে নিহত হন এক রিকশাচালক। পরে ডা.মোবারক আলী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। সে সময় আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেছিলেন পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ওই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। সৈয়দপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শহীদ পরিবারের সদস্য সাখাওয়াত হোসেন খোকন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুরে মর্মান্তিক গণহত্যার ঘটনা ঘটে ১৩ জুন। আগের দিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং ওদের দোসররা শহরে মাইকিং করে প্রচার করে অবরুদ্ধ মাড়োয়ারি ও হিন্দুদের ভারতে যাওয়ার জন্য একটি বিশেষ ট্রেনে তাদের চিলাহাটি সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া হবে। পরদিন শহরের সব হিন্দু ও মাড়োয়ারি পরিবারের সদস্যরা সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে ওই বিশেষ ট্রেনের যাত্রী হন। নির্ধারিত সময়ে ট্রেনটি চিলাহাটির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ট্রেনটি সৈয়দপুর শহরের গোলাহাটের শেষ মাথায় পৌঁছলে আগে থেকে ওত পেতে থাকা সশস্ত্র বিহারিরা ট্রেনের দরজা-জানালা বন্ধ করে অসহায় মানুষগুলোকে কুপিয়ে হত্যা করে। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি মায়ের কোলের শিশু,বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষও। সৈয়দপুরে গোলাহাট ট্রেন গণহত্যায় প্রায় সাড়ে চারশ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। পরে আগে থেকে করে রাখা বড় বড় গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয় হতভাগ্য মানুষগুলোকে। মহান মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার যে কয়েকটি বধ্যভূমির সন্ধান মিলেছে তার মধ্যে সৈয়দপুরের গোলাহাটের বধ্যভূমি অন্যতম। এছাড়াও শহরের অফিসার কলোনি ডাকবাংলোর সামনে স্হানীয় শহীদদের স্মরণে জাতীয় স্মৃতি সৌধের আদলে নির্মিত হয়েছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ।

আপনার জেলার সংবাদ পড়তে