বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নে ও পার্শ্ববর্তী দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের দশানী নদীতে পাল্টাপাল্টি কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে এতে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা প্রাচীন দশানী নদীটি আর নদীর বুকে এ বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে দুই উপজেলার ২৫ গ্রামের মানুষ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে বিপক্ষে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন।
উভয় উপজেলার মানুষ তাদের অংশে নদী ভাঙ্গনরোধ, কৃষিজমি ঘরবাড়ি, মসজিদ মাদ্রাসা রক্ষার জন্য নদীর মূল স্রোত ধারায় বাঁধ নির্মাণ করছে। একারণে বন্ধ হয়ে গেছে ওই নদীর গতিপথ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা দশানী নদী। ওই দশানী নদীটি দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা এবং বকশীগঞ্জ উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
ওই দশানী নদীর একটি শাখা দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের মাদারেরচর খাপড়াপাড়া গ্রামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একারণে নদী ভাঙ্গনের কবলে পরেছে ১১টি গ্রামের মানুষ। মাদারেরচর খাপরাপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী ঘুঘরাকান্দি, চর আইরমারী, মুন্দিপাড়া, মুন্সিপাড়া, কলকিহারা ও বাঘাডুবা গ্রামের মানুষ দশানী নদীর ভাঙ্গন রোধে ওই নদীর বুকে বাঁধ নির্মানের দাবী করে আসছে। খাপড়াপাড়া নদীতে একটি বাঁধ নির্মানের দাবীতে এবং নদী ভাঙ্গনরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানানোর পরও কোন অগ্রগতি না হওয়ায় খাপড়াপাড়া গ্রামের মানুষ নিজেরাই স্বেচ্ছাশ্রমে ওই নদীর মাঝখানে বাঁধ নির্মান করে নদীর পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন।
মাদারেরচর খাপড়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আখতারুজ্জামান জানান, এই নদী ভাঙ্গন রোধে অনুদান চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেছি। জিও ব্যাগ ও ব্লক ব্যবহার করে ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকল দপ্তরে আবেদন নিবেদন করেছি। কিন্তু কোন দপ্তরই আমাদের কোন প্রকার সহযোগিতা করেনি। ইতিমধ্যে আমাদের গ্রামে ২০-২৫ টি ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগা মাঠ, কবরস্থান সহ প্রায় সহস্রাধিক হেক্টর কৃষিজমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙ্গনের ফলে রাস্তাঘাট না থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। রাস্তাঘাট না থাকায় ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদীর ক্ষেত্রে ভালো কোন সম্বন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আর কোন উপায় না পেয়ে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা এই নদীতে বাঁধ নির্মাণ করেছি। তিনি আরো বলেন প্রকৃত দশানী নদী বকশীগঞ্জের আইরমারি মরারপাড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদীতে আমাদের স্ব- উদ্যোগে বাঁধ দেওয়ার ফলে আইরমারী মরারপাড়া গ্রামের মানুষ আমাদের সঙ্গে হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করে তারাও দশানী নদীতে পাল্টা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।
অপর দিকে ওই নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে বকশীগঞ্জ উপজেলায় মেরুরচর ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ খাপড়াপাড়ায় নদীর বুকে নির্মিত বাঁধ অপসারণের দাবি জানান। খাপড়াপাড়ায় নদীতে কৃত্রিম বাঁধ নির্মান করার ফলে নদীর পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও নদীর গতিপথ পরিবর্তন করায় ওই বাঁধ অপসারণের দাবি জানান বকশীগঞ্জ উপজেলার কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ।
তাদের দাবী দশানী নদীর ওই শাখার সামনের অংশে কৃত্রিম বাঁধ দেওয়ার ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হবে এবং বকশীগঞ্জ উপজেলার প্রায় ১০/১৫ কিলোমিটার এলাকা প্রবল নদী ভাঙ্গনের কবলে পরবে মেরুরচর ইউনিয়নের আইরমারী পুরানপাড়া, আইরমারী নতুনপাড়া, আইরমারী মরাপাড়া, আইরমারী খানপাড়া সহ ১০ গ্রাম । তারা আরো দাবী করেন খাপড়াপাড়া গ্রামের মানুষ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের অনুমতি ব্যতীত নদীর মাঝপথে বাঁধ নির্মাণ করেছেন যা আইনের পরিপন্থী। আইরমারী পুরানপাড়া গ্রামের আসাদ মিয়া জানান, মাদারেরচর খাপড়াপাড়ায় নদীর মাঝখানে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে তাতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হবে এবং ভাঙ্গনের ঝুকিতে পরবে মেরুরচর ইউনিয়নের স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ মাঠ, কবরস্থান। নদীগর্ভে বিলিন হবে শত শত হেক্টর কৃষিজমি। বাঁধ দেওয়ার ফলে চিরচেনা খরস্রোতা দশানি নদীটি মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে।
এদিকে সভা সমাবেশ মিছিল মিটিংয়ে কোন অগ্রগতি বা সমাধান না হওয়ায় এবং দুই উপজেলা শেষ সীমানায় ওই বাঁধ নির্মিত হচ্ছে। এনিয়ে প্রশাসনের কোন তৎপরতা কিংবা হস্তক্ষেপ না থাকায় দশানী নদীর বকশীগঞ্জ অংশেও নদীর মাঝখানে ড্রেজার বসিয়ে বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে বকশীগঞ্জ উপজেলার মেরুরচর ইউনিয়নের চার গ্রামের মানুষ। পাল্টাপাল্টি ওই বাঁধ নির্মাণের ঘটনায়
দেওয়ানগঞ্জ এবং বকশীগঞ্জ এই দুই উপজেলার মানুষ এখন মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। উভয় উপজেলার মানুষ একে অপরকে দোষারুপ করছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই উপজেলার মানুষের মধ্যে যেকোনো সময় সংঘর্ষের আশংকা করছেন অনেকেই।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় দশানী নদীর দুই অংশে পাল্টাপাল্টি বাঁধ নির্মাণ করায় ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা দশানী নদীর অস্তিত্ব বিলিনের পথে এবং হুমকির মুখে পড়েছে নদী কেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য। নদীর বুকে পাল্টাপাল্টি নির্মিত বাঁধ স্থায়ী হলে দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তিতে পরবে দুই উপজেলার প্রায় বিশ গ্রামের মানুষ।
এই সংকট উপেক্ষা করতে থাকলে দশানী নদী পুরোপুরি জীববৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়বে। নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন জীবিকাও বিপর্যস্ত হবে আর বর্ষা মৌসুমে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের কামালেরবাত্তী পর্যন্ত হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি প্লাবিত হবে এবং শুকনো মৌসুমে পানির চরম সংকট দেখা দিবে। খরস্রোতা ঐতিহ্যবাহী দশানী নদীটি এক সময় মানচিত্র থেকে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যাবে।
তাই খরস্রোতা নদীটি রক্ষা এবং নদী কেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সর্বমহলের সহযোগিতা কামনা করেন এলাকার সচেতন নাগরিক।
জামালপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ নকিবুজ্জামান খান জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবগত না করেই খাপড়াপাড়ায় দশানি নদীতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন বিষয়টি মনিটরিং করছে যে কোন সময় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ রানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান বিষয়টি যেহেতু দুই উপজেলার ঘটনা তাই জেলা প্রশাসন কে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে। উর্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।