রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে শহরের ব্যস্ত রাস্তায়। জানালার কাচে জলের দাগ গলে গলে নিচে নামে, ঠিক যেন কারও ফেলে রাখা চিঠির অক্ষরের মতো। তৃষা বসে আছে জানালার পাশে, এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে। বাইরে মেঘলা আকাশ, কিন্তু তার মন আরও বেশি ঘোলাটে।
এই জানালার পাশে বসেই সে বহু বছর আগে রাহুলের জন্য অপেক্ষা করত। তখন সদ্য কলেজ শেষ, মন খোলা, দিন রঙিন। রাহুল ছিল এক চুপচাপ কবিতাপ্রেমী ছেলেÑতার চোখে ছিলো রোদ, কথায় ছিল বৃষ্টি। বর্ষার দিনগুলোতেই তারা সবচেয়ে বেশি কাছে আসত। বৃষ্টির শব্দকে তারা ভাষা বানিয়ে ফেলেছিল।
একবার টানা তিনদিন বৃষ্টি নেমেছিল। শহর থমকে গিয়েছিল জলে, কিন্তু তারা হাঁটছিল কলেজ থেকে বাড়ি, ভিজতে ভিজতে। রাহুল হঠাৎ বলে উঠেছিল, ‘‘তৃষা, জানো? বৃষ্টি নামলে আমার মনে হয় আমরা দুজন ছাড়া বাকিটা পৃথিবী ভিজে যাচ্ছে। আমরা শুধু কথা হয়ে থাকি, শব্দ হয়ে বাজি।’’
তৃষা হেসে বলেছিল, “তুমি একদিন কবিতা হয়ে যাবে, আমি হবো ভেজা পাতা।” সেই মুহূর্তটা, সেই হালকা কাঁপা গলাÑসবই তৃষা আজও ভুলতে পারেনি।
কিন্তু জীবনের জলরঙ সবসময় মেলে না ক্যানভাসে। পড়াশোনা শেষে রাহুল দেশের বাইরে চলে যায়Ñছোট্ট একটা স্কলারশিপের হাতছানি। তৃষা অপেক্ষা করে, প্রথমে চিঠির জন্য, পরে ইমেইলের, তারপর কেবল একটা উত্তরবিহীন অনুপস্থিতির জন্য।
আজ বহু বছর পর, এই বর্ষার দিনে, সে আবার জানালার পাশে। এখন তার জীবনে আছে চাকরি, নীরবতা, আর অনেক প্রশ্ন। তবু বৃষ্টি এলেই যেন রাহুল ফিরে আসেÑভাষাহীন, কিন্তু গভীর। তৃষা জানে না, রাহুল কি ভুলে গেছে, নাকি হারিয়ে গেছে নিজের জগতে।
হঠাৎ তার ফোনে মেসেজের শব্দ। অচেনা নাম্বার থেকে একটি বার্তা:
‘‘আজ বর্ষা তোমার জানালার পাশে, এখনো কি আমি আছি?’’
তৃষার হৃদপিণ্ড এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়, জানালার কাঁচে আঙুল রাখে। বাইরে বৃষ্টি, কিন্তু চোখের ভেতরেও কিছু একটার ভিজে যাওয়া চলছে।
সে কোনো উত্তর লেখে না, কেবল চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা নিয়ে বলে ওঠে, “তুমি এখনো আছো জানালার গল্পে।”