দেশে সাংবাদিকতাই শ্রেষ্ঠ পেশা হবে কবে? (পর্ব : ০১)

মো: হায়দার আলী | প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল, ২০২৫, ০৭:৩৫ পিএম
দেশে সাংবাদিকতাই শ্রেষ্ঠ পেশা হবে কবে? (পর্ব : ০১)
মো: হায়দার আলী

সংবাদপত্রকে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনিবার্য এক উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সাংবাদিকদের জাতির বিবেকও বলা হয়। সাংবাদিকগণ হচ্ছেন জাতির জাগ্রত বিবেক। আর সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের দর্পণ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। তাই সৎ ও নির্ভীক সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনে। সংবাদপত্রের যাত্রা যথেষ্ট প্রাচীন হলেও বিংশ শতাব্দীতে সংবাদপত্র বিভিন্ন দেশীয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, বর্তমানেও করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতার গভীর তাৎপর্যপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের সাংবাদিকগণ তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকার স্বাক্ষর রেখেছেন। একটি দেশের সাংবাদিক, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, চেয়ারম্যান, মেয়র, এমপি, মন্ত্রী, শিক্ষক সমাজ যদি সৎ, যোগ্য, বাস্তববাদী হয় তবে যে কোন ধরনের উন্নতি করতে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। আমি নিজে যত্রতত্র সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জিতবোধ করি। পেশাগত কাজে কিংবা নিতান্ত প্রয়োজনে যদি কোথাও এই পরিচয়টা দিই তখন মানুষ সম্মান করে। কিন্তু আমার ধারণা, ওই সম্মানটা ভেতর থেকে হয় না। আমি সাংবাদিক হলেও হয়ত ব্যতিক্রম কেউ, এই ধারণা আমি তাদের ভেতরে জন্মাতে ব্যর্থ হই। তবুও আমি মনে করি, এই ব্যর্থতা আমার নিজের নয়, গোটা সাংবাদিক সমাজের। কারণ পেশাটাকে আমরা কেবল ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করছি এবং ওই ব্যর্থতার জায়গায় নিয়ে গেছি। যার কারণে পুলিশের পাশাপাশি এখন সাংবাদিকদের নামও উচ্চারিত হয়। পুলিশ কিংবা সাংবাদিকরাই (সবাই নয়) যে ওই দোষে দুষ্ট তা নয়, যে কোনো পেশার দিকে আপনি তাকাবেন প্রায় একই দোষের মানুষ পাবেন। ধরুন শিক্ষকতা পেশার কথা। শিক্ষকদের এক সময় আদর্শবান বলা হতো। কিন্তু এখন ওই অভিধায় তাদের আর অভিহিত করা হয় না। দেখা হয় না শ্রদ্ধার চোখেও। আদর্শের ওই জায়গা থেকে অনেক শিক্ষকই এখন সরে এসেছেন। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তহবিল তসরুফের অভিযোগ থেকে শুরু করে ছাত্রী ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ এন্তার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে নকল পরিবেশন করারও। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ঠিকমতো ক্লাস না নিয়ে এনজিওর কনসালটেন্সি করেন, গোপনে পড়ান অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও। সুতরাং নীতি-আদর্শের জায়গাটা সব পেশাতেই হয় খোয়া গিয়েছে, না হয় টলটলায়মান। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় নীতি-আদর্শে টিকে থাকা হচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টা আগুনে হাত রাখার মতো। লোভ-স্বার্থান্ধতা সবসময়ই আমাদের মধ্যে কাজ করে। তাই নীতি-আদর্শে টিকে থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার। নীতি-আদর্শ ত্যাগ করার নাম আধুনিকতা কিংবা উত্তর-আধুনিকতা নয়। তাই শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী কেউই নীতি-আদর্শে পুরোপুরি টিকে থাকতে পারেন না। সেক্ষেত্রে কেবল পুলিশ কিংবা সাংবাদিকের দোষ কী? ডাক্তার মিথ্যা সার্টিফিকেট দেন, সুযোগ বুঝে রোগীর শ্লীলতাহানি ঘটান, ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর মৃত্যুও ঘটান। কি খেলাধুলা, কি শিল্প-সাহিত্য, কি ব্যবসা-বাণিজ্য, কি চিকিৎসা যে কোনো একটি সেক্টরের দিকে তাকালেই বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র বোঝা যায়। আমরা কোনো কাজই মনোযোগ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করি না। করলেও সততার চেয়ে দুর্নীতি ও ফাঁকিই সেখানে প্রাধান্য পায়। এর জন্য মূলত রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। তারা সবাই মিলে দেশ ঠিক করলে দেশের প্রতিটি সেক্টরের এমন করুণ দশা হতো না। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই দেশকে এমন অস্থিতিশীল, আদর্শহীন, দুর্নীতিপ্রবণ জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। তাই বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বের শীর্ষে অবস্থান করে। যদিও বর্তমানে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। পুলিশ দুই টাকা, একটি সিগারেট অথবা এক খিলি পান পর্যন্ত ঘুষ খায় এমন অপপ্রচার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। সাংবাদিকরা অবলীলায় তার আদর্শের জায়গা থেকে সরে যায়, আর শিক্ষক, বিচারকরাও অভিযুক্ত হন ঘুষ-দুর্নীতিতে। এই দেশ, দেশের মানুষ একদিন ঠিক হবে। সাংবাদিকদের দুর্নাম কুড়াতে হবে না, বাংলাদেশেও সাংবাদিকতা শ্রেষ্ঠ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু কবে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমাদের দেশের ওই সব মানুষ গুলি কতটা সৎ, তার নমুনা হিসেবে দেখা গিয়েছে করোনা প্রস্তুতিতে ত্রাণের চাল, ডাল, সোয়াবিন তেল চুরির প্রতিযোগিতায় নেমেছিল সুইপার, পিয়নসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ বাণিজ্য, দরপত্রে যেমন সর্বোচ্চ দরদাতা কাজ পেয়ে থাকে তেমনি চাকুরির করার যোগ্যতা, মন মানসিকতা থাক আর না থাক সর্বোচ্চ উৎকোচ দাতা চাকুরি পাচ্ছেন।একজন ডিগ্রি পাশ বেকার ছাত্র দেড়বিঘা জমি এক নেতাকে লিখে দিয়ে কলেজে অফিস সহায়কের চাকুরি নিয়েছেন, একবছর পর বেতনভাতা হয়েছে। ওই জমির দাম ৩০/৩৫ লাখ টাকা। সে এখন কান্না করে বলেন চাকুরি না করায় ভাল ছিল। এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, উপজেলার চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, মহিলালীগ, কৃষকলীগসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদকগণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বাধ্য করেই নিয়োগ দিয়েছেন। এর বিনিময়ে কর্মচারী প্রতি ১০/১২ লাখ, শিক্ষক প্রতি ১৫ লাখ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রতি ২০/৪০ লাখ টাকা, সহঃ প্রধানের ক্ষেত্রে কয়েক লাখ টাকা কম নিয়েছেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী নিয়োগে নিয়েছেন ৮/১২ লাখ টাকা। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ আওয়ামী লীগ দলীয় পদ-পদবি গ্রহণ করে মাদার অফ মাফিয়া অধীনে অনুষ্ঠিত সকল নির্বাচনে নিয়ম ভঙ্গ করে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে হাজার হাজার ব্যালট পেপারে আগাম নৌকায় সীল মেরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করিয়েছেন। তারা নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। শুধু কি তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, অধ্যাপক, প্রধান শিক্ষক, সহঃ প্রধান, সহকারী শিক্ষক, সুপার, সহঃ সুপারগণ পদপদবীধারী আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলালীগের নেতারা নিয়োগবানিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হাটঘাট, করিডোর, কাস্টম, সাব-রেজিস্টার অফিস, বালুমহল, জলমহল, খাসপুকুরসহ বিভিন্নভাবে কোটি কোটি কাল টাকার সম্পদ গড়েছেন আর এমপি, মন্ত্রী নেতার গড়েছেন শ শ কোটি টাকার সম্পদ। এসব নিউজ করতে গিয়ে মফস্বলের সাংবাদিকগণ মামলা হামলা হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন। আর পট পরিবর্তনের পর ওই সব সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের অনেকেই এখন বিএনপি ও জামায়াতের ছত্রছায়ায় চলছেন। কেউ কেউ ভোল্ট পাল্টিয়ে ওই দুইটি দলের নেতা পাতি নেতা সাথে বিভিন্ন মিটিং মিছিলে যাচ্ছে, প্রথম দিকে আসন পাচ্ছেন। ফেস বুকে ছবি দিয়ে বীরদর্পে ঘুরে বেরাচ্ছেন। ভাগবাটোয়ারা করে অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য চালাচ্ছে চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপি কিছু সুবিধাবাদী নেতা মামলা করলেও রহস্যজনক কারণে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের পদধারী নেতা, লুটপাটকারী নেতা, জনপ্রতিনিধিদের নামে মামলা করা হয় নি। যারা লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, আওয়ামী লীগের নেতা ও মেয়র, উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, এমপি ফারুর চৌধুরীর ডান হাত বাম বলে খ্যাত, থিম ওমর প্লাজায় বসে কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, খাস পুকুর বাণিজ্য, খাদ্য গুদামসহ বিভিন্ন প্রকল্প করে লুটে নিয়েছেন কোটি কোটি, ওমর প্লাজায় ফ্ল্যাট, দোকান বাড়ি কিনেছেন রহস্যজনক কারণে মামলার আসামি করা হয়নি। এমনকি আওয়ামী লীগ দলীয় পদ নিয়ে প্রত্যেক নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসার হয়ে রাতের আধারে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে হাজার হাজার ব্যালট পেপারে নৌকায় সিল মেরেছিল তাদেরকেও আসামি করা হয়নি। তারা কিছু অসৎ নেতাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে আছেন। প্রতিমাসে দিতে হচ্ছে চাঁদা। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে সাইজ করতে খুন, লুটপাট, দোকান, জমি, পুকুর দখলের রাজত্ব কায়েম করছেন। সুবিধাবাদী নেতা বহিষ্কার হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলা হচ্ছে যা পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, আনলাইন নিউজ পোটাল, টিভি নিউজসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে। ওই সব সুবিধাবাদী বিএনপির নেতাদের থামাতে হবে এখনই। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী নেতাদের দ্রুত চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা এরা বিএনপি তথা তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার ভাল চান না এরা তৃতীয় পক্ষের হয়ে কিংবা শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের হয়ে বিগত দিনে এবং এখনও কাজ করছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর বিগত ১৫ থেকে ১৮ বছর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ রুপি নতা, জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের নিউজ করে গিয়ে সাংবাদিকদের হতে হচ্ছে হয়রানির সম্মুখীন ও প্রভাবশালীদের সন্ত্রাসী বাহিনীর দ্বারা প্রহৃত হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আওয়ামী সরকারের ১৫ বছর সময় থেকে সাংবাদিকতা পেশাটি দিনদিন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে পড়েছিল এখনও অব্যাহত রয়েছে, আর মফস্বল সাংবাদিকগণ বেশী ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের এক একটি নিউজ যেন এক একটি প্রতিপক্ষ। সংবাদপত্রের অবস্থাও ভাল নেই করোনাকালীন সময় থেকে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সাংবাদিক চাকুরি হারিয়েছেন এবং অনেকের বেতন ভাতা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে অনেক পত্রিকার অবস্থা নাজুক। বর্তমানে দীপ্ত টিভির সম্প্রচার বন্ধসহ তিন জন সাংবাদিককে বহিস্থার করা হয়েছে। সংবাদপত্রের ইতিহাসের দিকে একটু লক্ষ্য করা যাক, ১৫৬৬ সালে ভেনিসে হাতে লেখা সংবাদ প্রচার করা হতো। চারটি কাগজ একসঙ্গে গোল করে পেঁচিয়ে পাঠকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো সপ্তাহে সপ্তাহে। ইতালি ও ইউরোপের যুদ্ধ ও রাজনীতির খবর থাকত এসব কাগজে। ১৬০৯ সালে প্রথম ছাপা সংবাদপত্র বের হয় জার্মানি থেকে, জোহান ক্যারোলুসের উদ্যোগে। জার্মান ভাষায় প্রকাশিত রিলেশন নামের এই পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক। ইংরেজি ভাষার প্রথম সংবাদপত্র বের হয় আমস্টার্ডাম থেকে, ১৬২০ সালে। ফ্রান্সের প্রথম পত্রিকা বের হয় ১৬৩১ সালে এবং আমেরিকার প্রথম সংবাদপত্র বের হয় ১৬৯০ সালে। ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট। ১৭৮০ সালের জানুয়ারিতে জেমস অগাস্টাস হিকির সম্পাদনায় বের হয়। চার পাতার এই পত্রিকার আকার ছিল ১২ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চি। পর্তুগিজরাই প্রথম ভারতে মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে আসে। ১৫৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কাঠের তৈরি ছাপার যন্ত্র জাহাজ থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলের গোয়ায় নামানো হয়েছিল। ওই বছরেই নাকি সেখান থেকে বই ছাপা হয়ে বের হয়েছিল। কিন্তু সে বই কেউ চোখে দেখেনি। হুগলিতে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৭৮ সালে। এখন সে সংবাদপত্রে কতটা আধুনিকতার ছোঁয়া, বেড়ে সুযোগ সুবিধা, সংবাদ পাঠানো প্রকাশিত হতে আর সময় ক্ষেপণ করতে হয় না তথ্য প্রযুক্তির বদলাতে কয়েক সেকেন্ডে তা করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, অনলাইন পত্রিকা, মাসিক এরকম বিভিন্ন প্রকারভেদের পত্রিকা রয়েছে এবং দেশের সকল প্রধান জেলাসমূহে এসব পত্রিকা পাওয়া যায়। তবে শুধুমাত্র জেলাভিত্তিক পত্রিকাও ছাপা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে কোন দৈনিকের সান্ধ্যকালীন সংস্করণ প্রকাশ হয় না। তবে প্রচলিত ব্রডশীটের পত্রিকার পাশাপাশি সম্পূর্ণ অনলাইন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিদ্যমান রয়েছে এবং বর্তমানে অধিকাংশ ছাপানো পত্রিকারও অনলাইন সংস্করণ দেখা যায়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের নিবন্ধন শাখা থেকে সংবাদপত্রের নিবন্ধন প্রদান করা হয়। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত ৩০শে জুন ২০১৮ তারিখের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিবন্ধিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা ৩০৬১টি (অনলাইন গণমাধ্যম অন্তর্ভুক্ত নয়) যার মধ্যে ১২৬৮টি ঢাকা থেকে এবং ১৭৯৩টি অন্যান্য জেলা থেকে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে দৈনিক ১২১৩টি, অর্ধ-সাপ্তাহিক ৩টি, সাপ্তাহিক ১১৮১টি, পাক্ষিক ২১৩টি, মাসিক ৪১০টি, দ্বিমাসিক ৮টি, ত্রৈ-মাসিক ২৮টি, চর্তুমাসিক ১টি, ষান্মাসিক ২টি এবং বার্ষিক ১টি পত্রিকা রয়েছে। আগে বলা হয়েছে মহৎ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে সারা বিশ্বে ‘ফোর্থ স্টেট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটি শুধু বলার খাতিরে বলা নয়। হাতিয়ার হিসেবে সাংবাদিকতা সৎ রিপোর্টিংকে এর মৌলিক ভিত্তি (প্রিমিজ) হিসেবে এবং রিপোর্টিংয়ের সঠিকতাকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে বলেই সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আজকের এ জটিল টালমাটাল বিশ্বে সাংবাদিকতা নিজেকে সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে পেরেছে। এ রকমটা না করতে পারলে সাংবাদিকতা হয়ে যেত শুধু একটা ব্যবসার ব্যাপার। সাংবাদিকতার গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধ কাভার করার সময় ব্রিটিশ সাংবাদিক ও গবেষক হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ‘আমি হলাম সেই তাঁতি যার প্রতিদিনের বুননে উঠে আসে জাতির শোক, সুখ, জয়গানের গল্প।’ সংবাদপত্র হল রাষ্ট্রের দর্পণ। আর সাংবাদিকরা হলেন জাতির বিবেক। সাংবাদিকতাকে বলা হয় নির্মাণ বা ধ্বংসের গদ্য। সাংবাদিকতা জাতির চিন্তা-চেতনার শৈলী ও সুপ্ত মনমানসিকতা সৃষ্টিতে বা বিনাশে কতটুকু ভূমিকা পালন করে, তা কোনো বুদ্ধিমান, সচেতন ও বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে অস্পষ্ট নয়। মানবতার অতন্দ্র প্রহরী সৎ সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা জাতির জাগ্রত বিবেক এবং পাঠকরাই হচ্ছেন তার প্রাণশক্তি। তবে ভুয়া খবর মানুষের মধ্যে সাংবাদিকতা সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করে, এ কথা সবার জানা। তবুও ভুয়া খবর প্রচার করা হয় মিডিয়াগুলোতে, অনেক সময় বুঝেশুনে স্বেচ্ছায়, আবার অনেক সময় প্রাপ্ত তথ্যের সঠিকতা যাচাই না করে। ফলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে; তাতে বিপর্যয়ও ঘটে। শোনা যায়, কখনও কখনও পজিটিভ রিপোর্টিং করার জন্য কিংবা ভালো কভারেজ পাওয়ার জন্য মূল্যবান বা ব্যয়বহুল গিফট দিতে হয়। এমনকি, সত্য কিন্তু ইমেজ নষ্ট করতে পারে এমনতর! সংবাদ ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠানকে বিব্রত করা হয়। যেমন- এক দেশে একবার একটি হোটেলের পাশে একটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরদিন পত্রিকায় প্রথম পাতায় আকর্ষণীয় শিরোনাম দিয়ে প্রচার হয়- ‘(অমুক) শহরের একটি অভিজাত হোটেলে একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।’ ব্যস, আর যায় কোথায়? শুরু হল অভিজাত মহলে গুঞ্জন। সে হোটেলের ব্যবসায় নামল ধস। একবার গরুর মাংসের ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছিল যখন মিডিয়ায় খবর প্রকাশ পায় যে, গরুর মাংস খেয়ে ‘কোথাও’ কেউ ‘অমুক’ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এ ছাড়াও ভাষার ওপর ভালো দখল থাকলে একজন সাংবাদিক একটি বিষয়কে পুরোপুরি ড্যামেজ করে দিতে পারেন অথবা একই বিষয়ের চিত্র পাল্টেও দিতে পারেন। উদাহরণগুলো সঠিক সাংবাদিকতার পর্যায়ে পড়ে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। কেউ কেউ এ রকম সংবাদকে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ বলে থাকে। হলুদ সাংবাদিকতার প্রচলন বহু আগে থেকেই। এক শ্রেণির দুষ্টু, স্বার্থশিকারি সাংবাদিক হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়ে তাদের টার্গেট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হেয় করে স্বার্থসিদ্ধির অপপ্রয়াস চালায়। হলুদ সাংবাদিকতা যেহেতু তথ্য ও সত্যকে আড়াল করে মনগড়া সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু এরূপ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে সৎ সাংবাদিকরা সব সময় সোচ্চার। অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশন বা গুজব ছড়ানো কিংবা ‘ভীতিজনক’ শিরোনাম দিয়ে পাঠক/দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য হলুদ সাংবাদিকতা ব্যবহার করা হয়। এতে পত্রিকার কাটতি কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আকর্ষণ হয়ত সাময়িক বাড়ে; কিন্তু পরিণামে জনমানুষের কোপানলে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়।


লেখক: মো: হায়দার আলী; শিক্ষক, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট,