অসংখ্য শিশু-কিশোর শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পেটের তাগিদে শিশু শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। শিশু শ্রম প্রতিরোধে গত এক যুগে ৩০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নানা প্রকল্প নিয়েছিলো ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সরকার। বাস্তবতা হলো সেসব প্রকল্পের একটিও তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। উল্টো শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে শিশু শ্রমিক বেড়েছে সাড়ে ৮৬ হাজার। বর্তমানে দেশে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশু শ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। বর্তমানে শিশু শ্রমিকের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। যতদূর জেনেছি- শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের ফিরিয়ে কাজের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দিতে ২০১৮ সালে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’ নামে এ প্রকল্পের আওতায় এক লাখ শিশুকে ৯টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এ প্রকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে এসব শিশুকে ঝুঁকিমুক্ত কাজে ফেরানো যায়নি। কিন্তু আইন বলছে- কর্মক্ষেত্রে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও এরই মধ্যে ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমের তালিকা প্রকাশ করেছে। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, তালিকায় থাকা প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতেই এখনও শিশুদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় শিশু শ্রম নিরসন নীতি ২০১০-এ বলা হয়েছে, শিশু শ্রমের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা। নীতিমালায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শ্রম থেকে প্রত্যাহার ও দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনতে মা-বাবাকে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। তবে নীতিমালা প্রণয়নের ১৪ বছর পরও সেটি কার্যকর করা যায়নি। শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, দেশে শিশু শ্রম প্রতিরোধে আইন, নীতিমালা ও বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে। তবে এগুলো বাস্তবানুগ নয় বলে তা ফলপ্রসূ হয়নি। ভবিষ্যতে যে কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে তা বাস্তবের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা যাচাই করার আহ্বান জানান তারা।
বাস্তবতা হলো এই যে, ২০ বছরে দেশে শিশুশ্রম কমেনি, বরং বেড়েছে। এ সময়ে দেশে প্রায় এক লাখ শিশুশ্রমিক বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। এ ছাড়া বর্তমান শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তবে ১০ বছরের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের মতো কমেছে।
বিবিএস গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত তিন মাসজুড়ে দেশের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ওপর এই জরিপ করা হয়। জরিপে ৩০ হাজার ৮১৬ পরিবার অংশ নেয়। দেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এর মধ্যে ৪৫ লাখ শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের মধ্যে আবার ২০ লাখ ১০ হাজার শিশুশ্রমিক কোনো পারিশ্রমিক পায় না। যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা।
কৃষি, শিল্প ও সেবাÑতিন খাতেই শিশুশ্রম আছে। এর মধ্যে কৃষিতে ১ লাখ ৭০ হাজার, শিল্পে ১১ লাখ ৯০ হাজার এবং সেবায় ১২ লাখ ৭০ হাজার। জরিপের পাশাপাশি বিবিএস ‘সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ ২০২৩’ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। সরকার ৪৩টি খাতকে শিশুশ্রমের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ওই ৪৩টি খাতের মধ্যে পাঁচটি খাতকে চিহ্নিত করে জরিপটি করা হয়েছে। খাতগুলো হলো মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ (শুঁটকি উৎপাদন); পাদুকা উৎপাদন; লোহা ও ইস্পাত ঢালাই (ওয়েল্ডিং কাজ বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজ); মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) এবং ব্যক্তিগত ও গৃহস্থালিসামগ্রী মেরামত (বিশেষত টেইলারিং ও পোশাক খাত)। পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ খাতের ৪০ হাজার ৫২৫টি কারখানায় সব মিলিয়ে ৩৮ হাজার ৮ জন শিশু কাজ করে। তাদের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছেলে, বাকিরা মেয়ে। এর মধ্যে শুঁটকি উৎপাদনে ৮৯৮ জন; পাদুকা উৎপাদনে ৫ হাজার ২৮১ জন; ওয়েল্ডিং কাজ বা গ্যাস বার্নার মেকানিকের কাজে ৪ হাজার ৯৯ জন; মোটর যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে (অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ) ২৪ হাজার ৯২৩ জন এবং টেইলারিং ও পোশাক খাতে ২ হাজার ৮০৫ জন শিশু কাজ করে। অবশ্য সরকার দাবি করছে না, দেশে শিশুশ্রম নেই। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
যদিও আমরা ট্রাম্প-পুতিন-চিনফিং বা মোদিকে অনেক বড় বড় বুলি আওড়াতে শুনি। কিন্তু তাদের দেশে শিশুশ্রম মানবতার বিরুদ্ধে এগিয়ে চলছে প্রতিদিন। তারই ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বে সাড়ে ১৬ কোটি শিশু শ্রমে জড়িত। উন্নত বিশ্বে শিশুশ্রম তুলনা মূলক কম থাকলেও ভারত-পাকিস্তান-মিয়ানমারের মত বাংলাদেশেও তা ভয়াবহভাবে বাড়ছে। এমতাবস্থায় ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ কথাটিকে যদি দেশের বর্তমান সরকার প্রধান একটিবারের জন্যও ভাবেন, তাহলে সবার আগে শিশু-কিশোরদের শিক্ষাকে বেগবান করার লক্ষ্যে ‘প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পাঠ ও পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেয়াড় ব্যবস্থা করতে হবে’- তাদের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তা না হলে এই শিশুশ্রম একসময় অভিশাপ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের উপর নেমে আসবে। তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়- ‘ছিনতাই-চুরি-ডাকাতি’ ক্রমশ বেড়েই চলছে কেবল শিশুশ্রম বৃদ্ধির কারণে। কারণ যেই শিশুরা শ্রম দিতে দিতে একসময় পথ হারায়, তারাই অস্ত্র নিয়ে ছিনতাই করার জন্য রাস্তায় দাঁড়ায়, মাদকাসক্ত হয়ে যায়।
একদিকে কমমূল্যে শিশু শ্রমিক যেমন পাওয়া যায়, তেমনই নির্বিচারে খাঠানো যায় ভেবে বাংলাদেশে শিশুশ্রম বৃদ্ধিতে যারা বাড়াচ্ছেন, তাদের তালিকায় আমলা-মন্ত্রী-এমপি-জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি সিন্ডিকেটধারী ব্যবসায়ীরাও আছে। এমতাবস্থায় আমাদের উচিত সুপরিকল্পিত পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ভূমিকা রাখা। সেই ভূমিকা রাখতে হলে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে স্ব স্ব অবস্থান থেকে। যেমন- শিক্ষাঙ্গনে না গিয়ে কেউ যেন না যায় শ্রম দিতে সে জন্য মনিটরিং টিম করতে হবে। কি কারণে শিশুটি শ্রম দিতে যাচ্ছে, সেই কারণ চিহ্নিত করে সমস্যার সমাধান করে সেই শিশুর শিক্ষাকে কন্টিনিউ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘শ্রমিক হবে না একটি শিশুও’ শ্লোগানকে সামনে রেখে চলুন এগিয়ে যাই...
লেখক: মোমিন মেহেদী; ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক পূর্বাভাস