দেশের উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে প্রকাশিত ৪৫৬টি স্থানীয় সংবাদপত্রের মধ্যে ২৭৫টি (৬০.৩১%) সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অনিয়মিত অর্থাৎ বিজ্ঞাপন পেলে অথবা অর্থসংস্থান হলে ১৮টি (৩.৯৫%) সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক (বিআইজেএন) এর এক জরিপ এ তথ্য উঠে এসেছে। গত শনিবার ওই জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মার্চের করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রায় সব স্থানীয় সংবাদপত্র পুরোপুরি কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে এসব কাগজের মধ্য থেকে উল্লিখিত সংখ্যক সংবাদপত্র নিয়মিত এবং অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। কমপক্ষে ছয়টি জেলায় কোনো সংবাদপত্র আর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। সব মিলিয়ে এই জরিপে স্থানীয় সংবাদপত্র বন্ধে আর্থিক সংকটকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে বিআইজেএন। জরিপে রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ঢাকা বিভাগের ৩৪টি জেলার ৪৫৬টি স্থানীয় দৈনিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকার উপরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। মিডিয়াভুক্ত সংবাদপত্রগুলোর তালিকার ভিত্তিতে নয়, স্থানীয়ভাবে যে-সব সংবাদপত্র করোনাকালের আগে প্রকাশিত হতো- সেগুলো জরিপের আওতায় আনা হয়। জরিপের তথ্য সংগ্রহের সময়কাল ছিল ২৩ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত। প্রাথমিকভাবে ‘উদ্দেশ্যভিত্তিক দৈবচয়ন নমুনায়ন’ পদ্ধতিতে জেলা নির্বাচন করা হয়। এখানে মূল নির্ণায়ক ছিল ঢাকা শহরের বাইরে স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে গবেষণার আওতায় নিয়ে আসা। এরপরে দৈনিক এবং সাপ্তাহিক সংবাদপত্র নির্বাচন করা হয় প্রচার, পাঠকের কাছে পৌঁছানো এবং নিয়মিত প্রকাশের ধরনের ভিত্তিতে। স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো সম্পর্কে ধারণা নেওয়া ছিল এই জরিপের মূল লক্ষ্য। সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিষয়ে জানতে স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ মানুষ মিলিয়ে ২৮৭ জনের মতামত সংগ্রহ করে বিআইজেএন। তাদের মধ্যে ৮৬.৪১ শতাংশ মনে করেন স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদপত্র ওই স্থানের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে থেকে কখনো কখনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীপর্যায়ের দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, অতিব্যবহার, নানাবিধ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আইন বহির্ভূত ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন ভঙ্গের খবর প্রচারের এক-একটি মাধ্যম ছিল। যদিও এতে ব্যাপক মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে নানাবিধ বাধা বিঘ্ন সৃষ্টির চেষ্টাও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু, ওসব খবরগুলো কোনো না কোনোভাবে এক বা একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। এসব পত্রিকা চালু থাকলে করোনাকালে নানা খবরাখবর ও তথ্য প্রকাশিত হতো। এদের কেউ কেউ মনে করেন, স্থানীয়রা খুব সহজে এসব সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের কাছে যেতে পারতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খবর কোনো না কোনো স্থানীয় কাগজে ছাপা হতো। স্থানীয় কাগজে যে সব খবরাখবর পাওয়া যায় তার অধিকাংশই জাতীয় সংবাদমাধ্যমে স্থান পায় না। কিছু জাতীয় পত্রিকায় এই ধরনের খবরগুলো সামান্য ছাপা হলেও বিস্তারিত পাওয়া যায় না। ৮৬.৪১ শতাংশের একটি অংশ জানান, স্থানীয় প্রশাসন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং তাদের অনুসারীরা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের কারণে কিছুটা হলেও চাপের মধ্যে থাকতো। ৮.৭২ শতাংশ আবার কিছুটা ভিন্ন মতামত দেন। তাদের মতে, এসব সংবাদপত্রের মাধ্যমে নানা ধরনের সাংবাদিকতা বহির্ভূত অপকর্ম করা হতো। সাংবাদিক নাম ভাঙিয়ে তারা নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক পক্ষের সঙ্গে অবৈধভাবে যুক্ত ছিল। এর বাইরে ৪.৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী সংবাদপত্র বন্ধ নিয়ে কোনো ধরনের মতামত জানাননি। ওই জরিপে বিআইজেএন তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। এগুলো হলো- স্থানীয় পর্যায়ে বিশাল সংখ্যক সংবাদপত্র বন্ধ ও অনিয়মিত হওয়ার ফলে জনগণের সংবাদ প্রাপ্তির বিষয়টি মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় নানা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে, নানামাত্রিক কর্তৃত্বপরায়ণতা বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। প্রশাসনের এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্তরকেন্দ্রিক খবর প্রাপ্তির দূরত্ব বেড়েছে। তৃণমূলের সঙ্গে খবর প্রাপ্তিতে একক কেন্দ্রিকতার সৃষ্টি হতে পারে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার এবং সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপরে সংবাদপত্র বন্ধের কারণে একটি বড় মাত্রার দুর্বলতা দেখা দেবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্রমাগত দুর্বলতা আরও সংকীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়বে। যা পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও কাঠামোর জন্য একটি বড় ধরনের ক্ষতি। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও মুক্ত সংবাদমাধ্যমে পেশাদার সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের সংখ্যা কমে যাবে। সংবাদপত্রের অবস্থা সারাবিশ্বে কোথাও ভালো নেই। চলমান করোনাকালে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এমন অবস্থা অতীতে আর কখনো হয়নি। করোনা কারণে বিশ্ব একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা অভূতপূর্ব। সব দেশের অর্থনীতিই ভেঙ্গে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার সম্মুখীন। অর্থনীতির অবর্ণনীয় দুর্দশায় প্রতিটি দেশের এমন কোনো খাত নেই যা, আক্রান্ত ও বিপন্ন দশায় উপনীত না হয়েছে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনার ধাক্কা সব ক্ষেত্রে লেগেছে। সবচেয়ে বেশি লেগেছে সংবাদপত্র, ব্যাপক অর্থে মিডিয়ায়। সংবাদপত্রের আয়ের উৎস সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন। করোনাকালে এ দু’টি উৎসই অতিশয় ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। লকডাউনের সময় সংবাদপত্র দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় তো পরের কথা, জেলা শহরেও পাঠানো সম্ভব হয়নি। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর সার্কুলেশন সামান্য বেড়েছে। তবে এখনো সাবেক অবস্থায় যেতে অনেক বাকী। আদৌ সাবেক অবস্থায় যাবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। বিজ্ঞাপন কমেছে বললে ভুল হবে, নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায়, সংবাদপত্রগুলো চরম আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছে। এর ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ধ্বংসোন্মুখ সংবাদপত্র রক্ষায় কর্তৃপক্ষীয় তরফে নানা রকম পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে। কোনো কর্তৃপক্ষ বেতন কমিয়ে দিয়েছে সাংবাদিক ও কর্মচারীদের, কোনো কর্তৃপক্ষ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিয়েছে, কোনো কর্তৃপক্ষ আবার অনেককে বাধ্যতামূলক ছুটি দিয়ে দিয়েছে বিনা বেতনে। সাধারণভাবে সব সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষই পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা, প্রচার সংখ্যা ও রঙিন পৃষ্ঠা কমিয়ে দিয়েছে। এভাবে ব্যয় কমিয়ে, খরচ বাঁচিয়ে সংবাদপত্র রক্ষা করা যাবে কিনা, সে ব্যাপারে সকলে একমত নয়। এখন পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্রে বেতন হচ্ছে। আর সব অনিয়মিত বেতনের বৃত্তে ঢ়ুকে পড়েছে। আগেও অনেক সংবাদপত্রে অনিয়মিত বেতন হতো। এখন এক বেতন থেকে আরেক বেতনের মধ্যে গ্যাপ আরো বেড়েছে। এই দুঃসময়ে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন ও অসহায় হয়ে পড়েছে। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কিনা সে ব্যাপারেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংবাদপত্রের এই মারাত্মক অস্তিত্ব সংকটের সময়ে সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হলেও এখন পর্যন্ত সরকারের তরফে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সরকার সকল খাতেই প্রণোদনা দিয়েছে, সহায়তা দিয়েছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ছাড় দিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম সংবাদপত্র, যাকে কোনো কিছুই দেয়া হয়নি। সংবাদপত্র মালিক সমিতি বিভিন্ন সময়ে সরকারের নানা পর্যায়ে দেনদরবার, আলাপ-আলোচনা করেছে। প্রস্তাব ও দাবিনামা পেশ করেছে। এসব কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। এ ব্যাপারে সংবাদপত্র মালিক সমিতির বক্তব্য: সংবাদপত্র সেবাশিল্প হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। যেমন তৈরি পোশাক শিল্প মুনাফা অর্জনকারী শিল্প হওয়া সত্ত্বেও এর করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১২ শতাংশ। সংবাদপত্র সেবাশিল্প হওয়া সত্ত্বেও করপোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ। এবারের বাজেটে সব শিল্পের জন্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের করপোরেট ট্যাক্স ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা জরুরি ছিল। আয়কর অধ্যাদেশ অনুসারে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন-আয়ের ওপর টিডিএস ৪ শতাংশ এবং উৎসস্থলে কাঁচা মালের ওপর এআইটি ৫ শতাংশ-সহ মোট ৯ শতাংশ। অধিকাংশ সংবাদপত্রের মোট আয়ে ৯ শতাংশ লভ্যাংশই থাকে না। এই প্রেক্ষিতে টিডিএস ৪ থেকে ২ শতাংশ ও এআইটি শূন্য হওয়া উচিত। অপর পক্ষে মূল্যসংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে সংবাদপত্র ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত শিল্পের তালিকাভুক্ত। এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট, যা খরচের অর্ধেকের বেশি। অথচ সংবাদপত্রকে ভ্যাট দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। সংবাদপত্র মালিক সমিতির মতে, নিউজপ্রিন্ট আমদানির ক্ষেত্রে সংবাদপত্রকে সম্পূর্ণ ভ্যাটমুক্ত করতে হবে, কিংবা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণ করতে হবে। করোনাকাল সংবাদপত্রকে যে গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত করেছে, তাতে মালিক কর্তৃপক্ষের সামনে আয় বাড়ানোর কোনো সুযোগ খোলা নেই। আগে অস্তিত্ব রক্ষা, পরে অন্য কিছু। এজন্য প্রণোদনা ও সহযোগিতা দরকার। সেটা দিতে পারে সরকার। সংবাদপত্র মালিক সমিতি তার এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ এবং সরকারের কাছে বিজ্ঞাপনের বিল বাবদ পাওনা টাকা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। সব শিল্প ও খাত যদি প্রণোদনা ও সরকারি সহায়তা পায় তবে শিল্প হিসাবে বিশেষ করে সেবাশিল্প হিসাবে সংবাদপত্র কেন পাবে না, সেটা অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। ঋণ সুবিধা পাওয়া সব শিল্পেরই অধিকার। অন্য শিল্প পেলে সংবাদপত্র পাবে না কেন? সেবাশিল্প হিসেবে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চয় সংবাদপত্রের আছে। এই মুহূর্তে যখন ব্যাপক আর্থিক সংকটে, তখন সরকারের কাছে পাওনা বিজ্ঞাপনের বিলের টাকা পেলে সংবাদপত্রগুলো শ্বাস নিতে পারে, সাংবাদিক ও কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য খরচ নির্বাহ করা সম্ভবপর হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা ও আয় বাড়ানোর দায়িত্ব এর উদ্যোক্তা বা মালিকের। এ ব্যাপারে তাকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আগেই বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের আয়ের উৎস সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন। সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন যাতে বাড়ে তার ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সেদিকে সার্বক্ষণিক নজর নিয়োজিত রাখতে হবে। যেহেতু সংবাদপত্র একটি পণ্যও বটে, সুতরাং সেই পণ্যটি যারা কিনবে সেই ক্রেতা-পাঠাকের পছন্দের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সততা, বিশ্বা যোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তার অপরিহার্য শর্ত। আর জনপ্রিয়তা সার্কুলেশন বাড়ার প্রধান কারণ। বিজ্ঞাপন বাড়ার ক্ষেত্রে বর্ধিত সার্কুলেশন নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রদান করা হয়। আমাদের দেশে সরকারি বিজ্ঞাপনই বিজ্ঞাপনের প্রধান প্রবাহ। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের প্রবাহ এখনো ক্ষীণ। সরকারের বিজ্ঞাপনের একটা নীতিমালা আছে। তবে সে নীতিমালা অনেক সময় মান্য হতে দেখা যায় না। বিজ্ঞাপনের জন্য সরকারের বাজেট সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আবার বিজ্ঞাপন বণ্টনের ক্ষেত্রেও সরকারের ইচ্ছাই আসল। সরকারবিরোধী সংবাদপত্র সব সময় সব সরকারের আমলেই বঞ্চিত হয়। নানাভাবে সরকার সংবাদপত্রগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এজন্য বিজ্ঞাপনকে হাতিয়ার হিসাবে কখনো কখনো ব্যবহার হতে দেখা যায়। বিজ্ঞাপনের পাওনা বিলের টাকা যথাসময়েই পরিশোধ করার কথা। এ টাকা আটকে রাখার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ থাকতে পারে না। বিজ্ঞাপন বিলের টাকা সময়মতো পাওয়া গেলে সংবাদপত্রের আর্থিক সংগতি বাড়ে এবং এর সুফল সংশ্লিষ্ট সকলেই পেতে পারে। সংবাদপত্রশিল্প আর পাঁচটা শিল্পের মতো নয়। সেবাশিল্পের মধ্যেও সংবাদপত্র আলাদা। সংবাদপত্র তথ্যের বাহন। দেশবিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয় সংবাদপত্র। শুধু তথ্য নয়, মতামত, মতবাদ, জ্ঞানের নানা বিষয় পাঠককে উপহার দেয়। সংবাদপত্র সব সময় সত্য, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে ভূমিকা পালন করে। বস্তুনিষ্ঠতাই তার চালিকাশক্তি। সংবাদপত্র মতামত গঠন, প্রচার ও প্রসারে অবদান রাখে। যেকোনো বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের অবদান অগ্রবর্তী। সংবাদপত্র জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করে। জনমত তুলে ধরে, জন ইচ্ছা বিজ্ঞাপিত করে সরকারকে সহযোগিতা করে। অন্যদিকে জনস্বার্থে গৃহীত সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম, তার ভালো-মন্দ ইত্যাদি তুলে ধরে তথ্য ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে জনগণকে ক্ষমতায়িত করে। সংবাদপত্র একটি দেশের হুইপের কাজ করে, সচেতন ও শিক্ষিত করে তোলে। পার্লামেন্ট না থাকলে পার্লামেন্টের কাজ করে। সংবাদপত্র ছাড়া আজকে কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের কথাই কল্পনা করা যায় না। সংবাদপত্রকে বলা হয় ফোর্থ স্টেট। সুতরাং এই ফোর্থ স্টেটকে তার ভূমিকা ও অবদানের কথা মাথায় রেখেই সরকারের উচিত সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। এ কথা কে না জানে, এ দেশে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনে সংবাদপত্র পতাকাবাহীর ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় বিবেকের কণ্ঠস্বর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে সাংবাদিকরা। তারা তাদের অত্যুজ্জ্বল মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। ভয় ছিল, শঙ্কা ছিল, কিন্তু দায়িত্ব পালনে তা কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সাহসিকতা কিংবদন্তি তুল্য। অন্যান্য মিডিয়ার বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও তার সংবাদকর্মীরাও এই একই ভূমিকা রাখছে। তাদের অবস্থাও সংবাদপত্রের চেয়ে ভালো নয়। সরকারের অনেকেই গর্ব করে বলে থাকেন, বর্তমান সরকার সংবাদপত্র ও মিডিয়াবান্ধব। দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, এই সরকারের আমলে যত সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে, যত টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে এসেছে অতীতে কোনো সরকারের আমলেই সেটা দেখা যায়নি। তাদের এ কথায় দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত সংবাদপত্র, এত টিভি চ্যানেলের দরকার কি ছিল, যদি সেসব টিকেই না থাকে? বর্তমানে দেশে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা এক হাজার ২৭৭টি। এরমধ্যে জাতীয় বাংলা দৈনিক ২১৮টি, আঞ্চলিক বাংলা দৈনিক ২৯৩টি এবং ইংরেজি দৈনিক ৪০টি। মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, লাখের ওপরে প্রচার সংখ্যার বাংলা দৈনিকের মধ্যে রয়েছে, ভোরের কাগজ, আমাদের নতুন সময়, মানবকণ্ঠ, প্রতিদিনের সংবাদ, ইনকিলাব, বাংলাদেশের খবর, আমার সংবাদ, আমাদের অর্থনীতি, মানবজমিন, ভোরের ডাক, আমার বার্তা, আলোকিত বাংলাদেশ, ভোরের পাতা, নবচেতনা, ঢাকা প্রতিদিন, বর্তমান, মুক্ত খবর, আজকালের খবর, আজকের বিজনেস বাংলাদেশ, বণিক বার্তা, জনতা, খোলা কাগজ, গণকণ্ঠ, জনবাণী, সকালের সময়, হাজারিকা প্রতিদিন, স্বাধীন বাংলা, সংবাদ প্রতিদিন, ভোরের দর্পণ, সময়ের আলো, যায়যায়দিন, আমার সময়, লাখো কণ্ঠ, গণমুক্তি, বাংলাদেশের আলো, শেয়ার বিজ কড়চা, খবর ও সমাজ সংবাদ। আঞ্চলিক দৈনিকের মধ্যে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে বরিশালের আজকের বার্তা (৮০ হাজার ৫০)। এছাড়া ৫০ হাজারের বেশি প্রচার সংখ্যার আঞ্চলিক পত্রিকার মধ্যে আছে বগুড়ার করতোয়া, চট্টগ্রামের পূর্বকোণ ও আজাদী, বগুড়ার চাঁদনীবাজার এবং বরিশালের আজকের পরিবর্তন। প্রচার সংখ্যায় শীর্ষ দশে থাকা ইংরেজি দৈনিকের মধ্যে রয়েছে ডেইলি স্টার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ঢাকা ট্রিবিউন, ইনডিপেনডেন্ট, অবজারভার, বাংলাদেশ পোস্ট, এশিয়ান এজ, ডেইলি ট্রাইব্যুনাল ও বাংলাদেশ টুডে। পরিশেষে বলবো, সংবাদপত্রের যে সংকট, তা মালিক কর্তৃপক্ষের একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সংবাদপত্র মালিক সমিতি যে-সব দাবি ও প্রস্তাব দিয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সংবাদপত্রের সুরক্ষাই কেবল নয়, সাংবাদিকদের সুরক্ষায়ও পদক্ষেপ নিতে হবে। সংবাদপত্র মালিক সমিতি, সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন ও সরকার পক্ষকে একসঙ্গে বসে একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সংবাদপত্রকে তার স্বাধীন নিরপেক্ষ সত্যনিষ্ঠ সাহসী ভূমিকা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই। কেননা, যেকোনো সভ্য ও সম্ভাবনাময় জাতির অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য এটা অপরিহার্য। এজন্য বিজ্ঞজনেরা সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ-অর্থাৎ আইন বিভাগ (প্রশাসন বিচার প্রতিরক্ষা (উবভবহপব)-রাষ্ট্রের এ গুরুত্বপূর্ণ চার স্তম্ভের পরে পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন। রাষ্ট্রের অন্যান্য স্তম্ভ যখন অদক্ষতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অযোগ্যতার পরিচয় দেয়, তখন এ পঞ্চম স্তম্ভ সেগুলোকে যথাযথভাবে সক্রিয় রাখার ক্ষেত্রে উৎসাহ, পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে থাকে। তাই জাতীয় উন্নয়নে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সৎ, মেধাবী, যোগ্য, তথ্যপ্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এখন সংবাদপত্রে ঢ়ুকছে। পরিস্থিতি একদিন পাল্টাবেই। তখন বাংলাদেশে বসে আমিই মার্কেসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলব, সাংবাদিকতাই হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পেশা। আমরা নিঃস্বের কাতারে নেই, আমরাই শ্রেষ্ঠ। প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের প্রচারমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ব্যাপারে সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে সচেতন মহল মনে করেন।
লেখক: মো: হায়দার আলী; শিক্ষক, সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট