বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে নেমে এসেছে গভীর শোক। দেশ হারিয়েছে এক অনন্য সংগীত সাধক, গবেষক ও লেখককে—মুস্তাফা জামান আব্বাসী। শনিবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় রাজধানীর বনানীর একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
বরেণ্য এই সংগীতজ্ঞ বার্ধক্যজনিত
নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। শুক্রবার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিলে তাঁকে
হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর
মেয়ে শারমিনী আব্বাসী গণমাধ্যমকে জানান, চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার ভোরে তিনি চলে
যান না-ফেরার দেশে।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী শুধু সংগীতশিল্পী ছিলেন
না—তিনি ছিলেন এক
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। সংগীত, সাহিত্য, গবেষণা ও সমাজসেবায় তাঁর
অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
১৯৩৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ভারতের
কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুস্তাফা জামান
আব্বাসী। তাঁর শৈশব ও
কৈশোর কাটে কলকাতায়। তিনি
জন্মেছেন এক কিংবদন্তি সংগীত
পরিবারে। পিতা আব্বাসউদ্দীন আহমদ
ছিলেন পল্লিগীতির পথিকৃৎ, যিনি বাংলা লোকসংগীতকে
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তোলেন। চাচা
আব্দুল করিম, বোন ফেরদৌসী রহমান,
ভাতিজি নাশিদ কামাল—প্রতিটি নামই নিজস্ব ক্ষেত্রে
সমুজ্জ্বল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও
এমএ ডিগ্রি অর্জনের পর হার্ভার্ড গ্রুপ
থেকে মার্কেটিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। এরপর
দীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন
করেন।
লোকসংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল
নিবিড় ও গভীর। পাঁচ
দশক ধরে ফোক মিউজিক
রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
সংগ্রহ করেছেন হাজার হাজার লোকগান। তাঁর সম্পাদিত ও
রচিত গ্রন্থ—‘লোকসঙ্গীতের ইতিহাস’, ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’, ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’, ‘রুমির অলৌকিক বাগান’, ‘হরিণাক্ষি’ প্রভৃতি—বাংলা সংগীত গবেষণায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
বিশ্বের ২৫টিরও বেশি দেশে ভাটিয়ালি,
ভাওয়াইয়া, নজরুলগীতি ও অন্যান্য লোকসংগীত
পরিবেশন করে তিনি তুলে
ধরেছেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাসহ ইউনেসকোর ছত্রচ্ছায়ায় ১১ বছর ধরে
সংগীতবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘ভরা নদীর বাঁকে’,
‘আমার ঠিকানা’, ‘আপন ভুবন’ সহ
বেশকিছু জনপ্রিয় সংগীতানুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন তিনি। সমকালীন চিন্তাধারা ও সংগীতবিষয়ক বিশ্লেষণ
নিয়ে লিখতেন পত্রিকায়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত তাঁর
কলাম ‘গোধূলির ছায়াপথে’ পাঠকদের কাছে ছিল প্রিয়।
মুস্তাফা জামান আব্বাসীর কর্মজীবন বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। একুশে পদক ছাড়াও তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, লালন পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, জাতীয় প্রেসক্লাব লেখক পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা।