বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ক্রমশ সেই সকল মানুষদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, যাদের লক্ষ্য কেবল নিজের মত করে দেশ পরিচালনা। নির্বাচিত-অনির্বাচিত, বৈধ-অবৈধ, সিভিলিয়ান-ননসিভিলিয়ান, যাই হোক না কেন, নিজের সিদ্ধান্ত প্রথম সাঙ্গপাঙ্গদের উপর, পরে দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে। ছাত্রদের সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানও কি সেই পথে হাঁটছেন? প্রশ্ন দেশবাসীর মুখে মুখে থাকলেও গণমাধ্যম এই প্রশ্ন করছে না বা করতে পারছে না বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বিধায়। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে দেদারসে দুর্নীতি হচ্ছে, ডাকাতি-চুরি-ছিনতাই-দ্রব্যমূল্যও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সেই সাথে মোসাহেবি বাড়ছে, বাড়ছে অহেতুক কথা বলা এবং চিলের পিছে পিছে দৌড়ও। উদাহরণ হিসেবে বলি- ‘হাসিনাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ’ শিরোনামটির কথা। দেখুন-ভাবুন এবং মতামত জানান প্রথমে পরিবারে, পরে সমাজে। যাতে করে কোনোভাবেই কেউ একটা পয়সাও অপচয় করতে না পারে। যখন আমরা সবাই-ই জানি, শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে গেছে, তখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা কি? কি কারণে সময়-অর্থ অপচয় করতে হবে? এমন প্রশ্ন নির্মাণ হবে বলেই বৈষম্যমুক্ত আন্দোলন হয়েছে-বিজয় এসেছে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেবার কেউ নেই যখন তখন সুখবর এলো- এরই মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হাজির হওয়ার জন্য জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আইন-আদালতের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে বলতে চাই- ‘অপরাধী দেশের বাইরে যেহেতু, সেহেতু তাকে আনার জন্য আইনি পদক্ষেপ নিন। যে দেশে আছে, সেই দেশের সরকারের সাথে কথা বলুন। এতে করে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা যাবে। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অহেতুক অর্থ-সময় আর মেধা ব্যয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। সেই সাথে আরো বলতে চাই- ‘র’ ‘আইএস’ নিয়ে ষোল বছর অনেক রকমের ঘটনাপ্রবাহ আমরা দেখেছি। দয়া করে বৈষম্যমুক্ত আন্দোলনের ফসল হিসেবে আসা সময়ে অন্তত এসব করে সময় নষ্ট করবেন না-জাতিকে কেউ বিভ্রান্ত করবেন না। বিএনপির অন্যতম শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের গুম হওয়া ও ভারতে যাওয়া নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে একটা স্বার্থান্বেষী মহল। প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলে সালাউদ্দিনের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর শাসনামলে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের লড়াই সংগ্রামের তথ্য তুলে ধরেন প্রেস সচিব। সালাউদ্দিন আহমেদের গুম হওয়া ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়ে তার লড়াই নিয়ে প্রেস সচিবের পোস্টটি হলো- ‘যেদিন নিরাপত্তা বাহিনী সালাহউদ্দিন আহমেদকে অপহরণ করে, গুম করে সীমান্ত পেরিয়ে পাঠিয়ে দেয় আরও দূরে, তার কয়েক সপ্তাহ আগেই তিনি বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে গোপন একটি জায়গা থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার দলটির ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল। খালেদা জিয়াকে গুলশানের কার্যালয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। দলের শীর্ষ নেতারা কেউ আত্মগোপনে চলে যান, কেউবা পুলিশের বিশেষ শাখা বা র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। আমি ও আমার দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ক্রিস ওটন ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গোপনে প্রবেশ করে এএফপির জন্য তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সিভিল পোশাকের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের ব্রিটিশ হাইকমিশনের সদস্য ভেবে ভেতরে ঢ়ুকতে দেয়। সেই সময় প্রতিদিন আমরা সালাহউদ্দিন আহমেদের বিবৃতি পেতাম। ক্রিস ও আমি তার বিবৃতিগুলো আমাদের প্রতিবেদনে জোরালোভাবে ব্যবহার করতাম, কারণ সেই বিবৃতির লেখাগুলো ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী, নিখুঁত ও ক্ষুরধার ছিল। আমি সব সময়ই মনে করতাম রুহুল কবির রিজভী দেশের অন্যতম আবেগি রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু তার লেখা বিবৃতিগুলো ছিল জটিল ও দুর্বোধ্য। সেখান থেকে শক্তিশালী কোনো উদ্ধৃতি বের করা কঠিন হতো। কিন্তু যখন রিজভী গ্রেফতার হলেন এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ গোপন অবস্থান থেকে মুখপাত্রের দায়িত্ব নিলেন, তিনি বিএনপির ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অসাধারণ বিবৃতি পাঠাতে শুরু করলেন। সেগুলো ছিল বোমার মতো, যা সরাসরি শেখ হাসিনার শাসনকে চ্যালেঞ্জ করছিল। সেই বিবৃতিগুলোর ভাষা ছিল কঠোর এবং সবসময় লক্ষ্যভেদী। আমরা নিরাপদ সূত্র থেকে জানতে পারি, শেখ হাসিনা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন যে, তিনি সালাহউদ্দিন আহমেদকে ধরতে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। সালাহউদ্দিন আহমেদের পরিণতি কী হতে পারে তা অনুমেয় ছিল। ঠিকই একদিন ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সালাহউদ্দিন আহমেদ অপহরণ ও তারপর গুমের শিকার হন। তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ তার মুক্তির দাবিতে একটি সাহসী আন্দোলন শুরু করেন। তার লড়াই ছিল চোখে পড়ার মতো ও দেশের অন্যতম সাহসী প্রচেষ্টা। মায়ের ডাক-এর হাজেরা খাতুন ও তার মেয়েদের সঙ্গে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। সম্ভবত হাসিনা আহমেদের তৈরি করা সেই আন্দোলন ও প্রতিবাদ আংশিকভাবে হলেও নিরাপত্তা বাহিনীকে সালাহউদ্দিন আহমেদকে সীমান্ত পেরিয়ে শিলং পাঠাতে বাধ্য করেছিল। আজ বিএনপির অনেক তরুণ, যারা কিনা দিন দিন আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, তাদের মতো কিছু কর্মীও এই সাহসী অধ্যায়গুলো ভুলে গেছে। আর গতকাল আমরা তার বিরুদ্ধে কিছু ঘৃণ্য অপপ্রচার দেখলাম। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সংগ্রামগুলোই শেখ হাসিনার সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসনামলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অধিকাংশ মানুষ আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ভুলে গেছে। ভালো সময় যেন সব খারাপ স্মৃতিই মুছে দিয়েছে।’ এমন একটা স্ট্যাটাস শফিক সাহেব লিখলেন ফেসবুকে। কিন্তু ভাবলেন না, তিনি সবার আগে একটি সরকারের মুখপাত্র। ইচ্ছে করলেই তিনি কোনো দলের বিরুদ্ধে, কোনো নেতার বিরুদ্ধে লিখতে পারেন না। যেমন পারেন না, প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্য কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী। সাধারণ মানুষ যা খুশি লিখবে-বলবে, কেবল তা মনোযোগ দিয়ে শুনে-বুঝে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সাথে রাতের আঁধারে রাজপথে নেমে, দিনে ছদ্মবেশে বাজারে গিয়ে-অফিস আদালতে গিয়ে দেখবে সমস্যাগুলো এবং সমাধানে নিরন্তর কাজ করবে। বলবে কম, কাজ করবে বেশি সঠিকভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার মহান লক্ষ্যে। তা না করে কেবল ফেসবুকে কীসের লেখালেখি। ফেসবুক কি সংসদ? যে এখানে বললেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে, পত্রিকায় ছাপতে হবে, টিভিতে প্রচার করতে হবে? নিশ্চয়ই না। ভুল থেকে না শিখে সেই ভুলের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা মোটেই ভালোর লক্ষণ নয়। এমতাবস্থায় দেশের চলমান অস্থিরতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দূর করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বলতে চাই- বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সব পক্ষকেই বলি, মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে না চাইলে সংঘাতের পথ ছেড়ে সমঝোতার পথ ধরুন। দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছেড়ে ঐকমত্যের পথ ধরে এগুবার চেষ্টা করেন। কোনো রাজনৈতিক দল নিজেদেরকে বর্তমান সরকারের সরকারি দল বা বিরোধী দল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন না। এতে করে রাজনীতি আরো কলুষিত হবে-বাংলাদেশ আরো একধাপ অন্ধকারের পথে এগিয়ে যাবে। একথাও সত্য যে, সরকার ফেল করলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আরেকটা সরকার গঠন প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে এবং তখনই শুরু হবে এক ভয়াবহ নৈরাজ্য। যা থামানো মত অত শক্তি উদ্ভট স্ট্যাটানপ্রদানকারী রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতাধর কারোই নেই বলে আমি মনে করি। সেই সাথে বলতে চাই- নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি ১২ বছর ধরে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসলেও আজ যেমন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে যুগপৎ, মঞ্চ বা মোর্চা না করায় একটা সময় আসবে এই ধারা অব্যাহত থাকলে এখনকার আমন্ত্রণ পাওয়া দলগুলো তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। যা গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য নষ্ট করলেও হয়ত তখন তা শিরোধার্য হবে। কিন্তু তবু জনগণের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, বাংলাদেশে গত ত্রিশ বছর ধরে লেখক হিসেবে-সাংবাদিক হিসেবে প্রত্যাশা করি- নির্বাচন কমিশনে বৈষম্যমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। যদিও বলা হচ্ছে- কমিশন গঠনে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবুও কোনো কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্ম বেশি সুবিধা পাচ্ছে নিবন্ধনের আগেই, তা আমাদেরকে ক্রমশ বৈষম্যের পথে নিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ চায়- এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা হোক। সাধারণ মানুষ যে, ‘মার্চ ফর ইউনূস’-এর পক্ষে না, তা আন্দোলনকারীদের বক্তব্য আর একশত ২৩ জনের উপস্থিতির মধ্য দিয়েই প্রমাণিত। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সবাই পথ চলুক- বলুক কম, করুক বেশি। অপরাধী-খুনিদের বিচার বাস্তবায়ন হোক। কোনো স্থাপনা ভাঙচুর বা দখল না করে সংস্কার ও বিচার একই সঙ্গে চলুক-জ্বলুক জ্ঞানের আলো- দেশটা থাকুক ভালো...
লেখক: মোমিন মেহেদী; চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি