আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন বহির্ভূতভাবে পুশইন অব্যাহত রেখেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাতে এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে এমন ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়, জানিয়ে বাংলাদেশ চিঠি দিলেও তা মোটেই আমলে নিচ্ছে না ভারত সরকার। এছাড়াও বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে দফায় দফায় পতাকা বৈঠক হলেও চোরাপথে বা বিজিবির অগোচরে পুশইনের ঘটনা বেড়েই চলছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের হুমকি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পুশইনের এসব ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যাদের পুশইন করা হচ্ছে আসলে তারা কারা, কোন দেশের নাগরিক, এসবের কিছুই জানা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে ভারত নিজেদের আইন ও সংবিধানও লঙ্ঘন করছে বার বার। তারা আরো মনে করেন, এই পুশইন বাংলাদেশকে চাপে রাখার একটা কৌশল। ভারত এই ধরনের কাজ অতীতেও করেছে, এখনো করছে। এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আরও জোরালো আলোচনার পরামর্শ দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইস্যুটি আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার কথা বলেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসরত অবৈধ ভারতীয় নাগরিকদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে সরকারকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ভারতের আচরণ বরাবরই আক্রমণাত্মক। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) নিয়মিত বাংলাদেশের মানুষকে গুলি করে বা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সীমান্ত দিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো বা ‘পুশইন’ করা। দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ৪ থেকে ৭ মে বাংলাদেশের পাঁচটি জেলা দিয়ে ভারত থেকে ১৬৭ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জনকে খাগড়াছড়ি, ৪৬ জনকে কুড়িগ্রাম, ২৩ জনকে সিলেট, ১৫ জনকে মৌলভীবাজার, ১০ জনকে চুয়াডাঙ্গায় পুশইন করা হয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ৭ মে থেকে এ পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১১১, কুড়িগ্রামে ৮৪, সিলেটে ১০৩, মৌলভীবাজারে ৩৩১, হবিগঞ্জে ১৯, সুনামগঞ্জে ১৬, দিনাজপুরে ২, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৭, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯, পঞ্চগড়ে ৩২, লালমনিরহাটে ৭৫, চুয়াডাঙ্গায় ১৯, ঝিনাইদহে ৪২, কুমিল্লায় ১৩, ফেনীতে ৩৯, সাতক্ষীরায় ২৩ এবং মেহেরপুরে ৩০-সহ ৯৭৫ জনকে পুশইন করেছে ভারত। এছাড়া সুন্দরবনের গহিন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে।
একটি দেশের কোনো নাগরিক আরেকটি দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে তাঁকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনকানুন, রীতিনীতি অনুসরণ করে ফেরত পাঠাতে হয়। কিন্তু, ভারত কোনো ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এক প্রকার গায়ের জোড়ে এই মানুষগুলোকে বাংলাদেশে পুশ ইন করছে, তা সম্পূর্ণ বেআইনি, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থি। এখনো সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে পুশ ইনের জন্য মানুষ জড়ো করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। নিকট অতীতে ভারত কর্তৃক এভাবে বড় ধরনের পুশইনের ঘটনা না ঘটলেও অতীতে ঘটেছে। ২০০২-০৩ সালের দিকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় থাকার সময় ভারত থেকে প্রায়শই এই ধরনের পুশইনের ঘটনা ঘটত। এরপর দুই দেশেই রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের পুশ ইনের ঘটনা অনেক দিন ঘটেনি। সম্প্রতি আবারও ভারত কর্তৃক পুশইন করা শুরু হলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পুশ ইনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে দেখার কোন সুযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে ভারতের অনুগত সরকারের পতনের পর ভারত নানাভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। পুশইন সেই পদক্ষেপেরই অংশ বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। ভারতের সরকারের অনুগত সংবাদমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
বিজিবি জানিয়েছে, পুশইন হওয়া বেশিরভাগ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভারতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিলেন। কেউ কেউ ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হয়ে জেলও খেটেছেন। অনেকে বলছেন, তারা ভারতেই জন্মেছেন এবং ভারতীয় নাগরিক। ফলে প্রশ্ন উঠেছে-ভারত কেন তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে? তাদের মতে, এসব পুশইন কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, সরাসরি সীমান্তে এনে বাংলাদেশে ঢ়ুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি রাতে, দুর্গম সীমান্ত পয়েন্ট বা জঙ্গলের ভেতর দিয়েও লোকজন ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। বিজিবি জানিয়েছে, এই কার্যক্রম সম্পূর্ণ বেআইনি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পরিপন্থি।
ভারত থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে লোকজনকে পুশইনের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকারকর্মীরাও। তাদের মতে, আদালতের রায় ছাড়া কাউকে ঠেলে পাঠানো বেআইনি। আর নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক ধরনের চাপ তৈরি করতে হঠাৎ পুশইন। কেউ কেউ এটাকে উসকানিও মনে করছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করে ভারত। উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশনে হামলাও হয়। এরই মধ্যে গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর অনুপ্রবেশকারী ধরতে অভিযান শুরু করে ভারত। অবৈধভাবে ভারতে বসবাসকারীদের আটক করা হয়। এদের অনেককে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। ফিরে আসার পর অনেকে নির্যাতনের অভিযোগ করছেন। তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। গত ৪ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে ৩৪৬ জনকে ঠেলে পাঠানোর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকজন রোহিঙ্গাও রয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ। বাংলাদেশের জনগণকে কি এত দুর্বল জাতি ভাবছেন? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশ, যে জাতি ৩০ লাখ শহিদ আর দেড় হাজার শিশু-কিশোরের রক্তের বিনিময়ে মাত্র কয়দিন পূর্বেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলো যে জাতি তাকে দুর্বল করে দেখা ঠিক না। বর্তমানে ভারত থেকে বেশকিছু মানুষকে পুশইন করা হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য পন্থা নয়। ভারত যদি মনে করে তাদের দেশে অবৈধভাবে কোনো বাংলাদেশি বসবাস করছে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আইনসম্মত যে প্রক্রিয়া আছে, তা অনুসরণ করে দুই দেশের সম্মতিতে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে। আমাদের সম্মতি না নিয়ে যে কাউকে পুশইন করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের সঙ্গে জোরালো ভাষায় আলোচনা করতে হবে।
ভারতের সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটি রায় এক বিবৃতিতে বলেছেন, যদি কোনো নাগরিক অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করে, তাহলে তাঁকে আইনিভাবে চিহ্নিত করতে হবে। এখানে ফরেনার্স অ্যাক্ট রয়েছে। আদালতের মাধ্যমে অবৈধ বিদেশি নাগরিক শনাক্ত হওয়ার আগে তাঁকে জোর করে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে- এটি বেআইনি। গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে অভিযান চালিয়ে ধরা হচ্ছে। এরপর কাউকে আবার বিমানে উড়িয়ে সীমান্তে নিয়ে ওপারে ঠেলে পাঠানো হয়। আদালতের কাজ এখনো পুলিশ করছে। পুলিশ ও প্রসিকিউশন একই হলে কীভাবে চলবে?
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সম্পর্কে চির ধরায় বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে অবৈধ ও ন্যক্কারজনক পুশইন তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত। কূটনৈতিকভাবে এটি সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এরপরও অবৈধ পুশইন বন্ধ না হলে বাংলাদেশকে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। ভারতীয়রা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে নতুন এ কৌশলের পথ বেছে নিয়েছে। বিজিবি থেকে জানানো হয়েছে, পুশইন ঠেকাতে সীমান্তবর্তী এলাকায় কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এ ধরনের আচরণ শুধু সীমান্ত সমস্যাই নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির কৌশলও হতে পারে। পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নতুন করে টানাপড়েন তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক মহল। সীমান্ত পরিস্থিতির এমন উত্তেজনাপূর্ণ বাস্তবতায় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে, এই ‘অবৈধ পুশইন’ আগামী দিনে আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুশইনের পেছনে কাজ করছে দিল্লির বৈরিতা। ঢাকাকে বেকায়দায় ফেলতেই তারা এমন করছে। সামনে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিজেপি সমর্থকদের চাঙ্গা করতে এবং ভোটের হিসাব থেকে ভারত এমন কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারত ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ চাইছে, সে কারণেও এমন করতে পারে।
ভারত যেন সীমান্ত দিয়ে এভাবে পুশইন অব্যাহত রাখতে না পারে, সে জন্য সীমান্তে নজরদারি আরও জোরদার করা প্রয়োজন। একই সাথে অবৈধ পুশইন বন্ধ না হলে বাংলাদেশকে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে।
লেখক: এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া; কলামলেখক, রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক