নিয়োগ বাণিজ্যে ‘তালন্দ কলেজে’ শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির

মো: ইমরান হোসাইন; তানোর, রাজশাহী
| আপডেট: ৩০ মে, ২০২৫, ১১:৪১ এএম | প্রকাশ: ৩০ মে, ২০২৫, ১১:৪১ এএম
নিয়োগ বাণিজ্যে ‘তালন্দ কলেজে’ শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির
রাজশাহীর তানোর উপজেলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তালন্দ ললিত মোহন কলেজ অত্যন্ত সুপরিচিত। আছে নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস, সুবিশাল ক্লাশ ভবন, ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেল ও শতাধিক শিক্ষক। তবে নেই সেই আগেরমত প্রাণচাঞ্চল্য ও শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত কলেজটি ছিল স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের অবৈধ অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস! বিগত দশ বছরে ১৬-২০ তম গ্রেডে সরাসরি নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কলেজের বিগত গভর্নিং বডির কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষকের এমপিও ভুক্তির জন্যেও নেওয়া হতো মোটা অংকের টাকা। উপর মহলে সাংসদ প্রতিনিধি আবুল বাসার সুজন আর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন মৃধা এবং কলেজ কমিটির সভাপতি সেলিম উদ্দিন কবিরাজ মিলে কলেজের অর্থ-সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছেন ইচ্ছামতো। উল্লেখ্য উক্ত কলেজটি হিন্দু জমিদার পরিবারের দানকৃত সম্পত্তির উপর অবস্থিত। কলেজের নামে পুকুর, দীঘি, আবাদি জমিসহ বেশকিছু ভূ-সম্পত্তি রয়েছে যা ছিল গত ১৭ বছরের আওয়ামী সিন্ডিকেটের ভোগ্যপণ্য। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন মৃধা নিয়ম বহির্ভূত ভাবে গত আড়াই বছরের অধিক সময় ধরে পদ আকড়ে বসে আছেন। আর সেলিম উদ্দিন কবিরাজ তো আরেক কাঠি সরেস, উনি গত আওয়ামী আমলে দুইবার সভাপতি হয়েও তার অর্থ ক্ষুধা নিবারন হয়নি। এই মিলিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, চলছিল মহাসমারোহে। তবে, এসব দূর্নীতির বিষয়ে অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) জসিম উদ্দিন মৃধা অস্বীকার করে বলেন, বিগত সময়ে কলেজে কোন অনিয়ম হয়নি। এখন যারা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছন তারা কলেজ কমিটির সদস্য ও সভাপতি হবেন। তাদের অভিযোগ আমি নাকি তা হতে দিচ্ছি না বলে এড়িয়ে গেছেন তিনি। সাবেক সভাপতি ও সাবেক অধ্যক্ষ সেলিম উদ্দিন কবিরাজ একই কথা বলে মোবাইল সংযোগ বিছিন্ন করেন তিনি। তবে, এবারে বিধি বাম ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের ফলে তাদের লুটপাটে বাধ সাধে স্থানীয় সচেতন ছাত্র-সমাজ ও এলাকাবাসী। আওয়ামী দাপটে এতদিন কেউ মুখ না খুললেও শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল! গত ৫ আগস্ট সরকারের পট পরিবর্তন হওয়ায় সেলিম উদ্দিন কবিরাজ ও জসিম উদ্দিন মৃধা পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা গত বছরের ১৫ আগস্ট গোপনে একটি অখ্যাত পত্রিকায় ৪টি শুণ্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। দেশের চরম সংকটময় মূহুর্তে তথা ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের ১০ দিনের মাথায় এমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কথা ছাত্র-জনতা জানতে পেরে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সভাপতি সেলিম উদ্দিন কবিরাজের নিকট জবাবদিহি চাইতে গেলে তারা সেটি নাকচ করে দেয়। পরবর্তীতে কলেজে শিক্ষার্থীরা তালা ঝুলিয়ে দিলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন মৃধা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কথা স্বীকার করে নেন। উক্ত ঘটনা জানাজানি হবার পর জনমনে কলেজ সম্পর্কে নানাবিধ প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে। বিভিন্ন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে জানা যায়, একটি গোপন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে তালন্দ কলেজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ বাণিজ্য করা হয়। কলেজ ফান্ডে ডোনেশন জমার কথা বলে একেকটা পদে ১৬-২০তম গ্রেডের বিপরীতে ১২ থেকে ২০ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়। যা পুরোটাই ভাগ করে নিতেন প্রতিনিধি আবুল বাসার সুজন, সভাপতি সেলিম কবিরাজ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন মৃধা। কিঞ্চিৎ ভাগ যেত স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের পকেটে। এর আগেও বহুবার নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সুজন গ্রুপ ও তানোর পৌর মেয়র ইমরুল গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। এসব ব্যাপার প্রকাশ্যে আসার পর দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টিয়ে যায়। গত ১৫ আগস্ট গোপন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও বিভিন্ন অনিয়মের জেরে এলাকাবাসী আওয়ামী লীগের দোসর সেলিম উদ্দিন কবিরাজকে ধিক্কার জানিয়ে কলেজ কমিটি হতে অব্যাহতির দাবি জানায়। তবে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুকৌশলে নিজেদের সিন্ডিকেট বজায় রাখতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এডহক কমিটি গঠন করে তার নাম সুপারিশ করে পূর্নাঙ্গ কমিটিতে তৃতীয় বারের মত সভাপতি হিসেবে পাঠায়। ব্যাপারটি জানাজানি হলে, স্থানীয় সচেতন নাগরিক ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণের সমর্থনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে উক্ত কলেজকে দূর্নীতিমুক্ত করার অভিপ্রায়ে মো. ফনির উদ্দিন (অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক) কে সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। তবে, চিহ্নিত আওয়ামী লীগের দোসর সেলিম উদ্দিন কবিরাজ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন মৃধাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নব-নির্বাচিত সভাপতিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং করতে অসহযোগিতা করেন ও পূর্ববর্তী সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তরে গড়িমসি করেন। তাদের গোপন আতাত ও নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনা আড়াল করতে তারা জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী শিক্ষক দ্বারা পূর্বের গঠিত শিক্ষক প্রতিনিধি ও অভিভাবক প্রতিনিধিকে নিয়ে কৌশলে মিটিং বানচাল করে। এমনকি গত মার্চ ও এপ্রিলে ৩টি সভা আহবান করার পরেও কেউ উপস্থিত হননি, তবে মজার ব্যাপার গত ২৯ এপ্রিল হঠাৎ পুনরায় সেলিম উদ্দিন কবিরাজ সভাপতি হয়ে আসলে তারা সকলেই আবার ৩ মে ডাকা মিটিংয়ে অতি-আনন্দে তারা সভায় উপস্থিত হন। এ-থেকে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ও এলাকাবাসী সহজেই বুঝে যায় সেলিম উদ্দিন কবিরাজ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জসিম উদ্দিন মৃধার কারসাজিতেই গোপন আতাঁতে অসহযোগীতায় মূলত মো. ফনির উদ্দিনকে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে কৌশলে বাধা দেয়া হয়েছিল। এই ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও জনরোষ দেখা দিলে পরদিনই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিদ্ধান্ত আসে মো. ফনির উদ্দিনকে পুনরায় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেন। তবে, মেইল প্রাপ্তির পরেও ৪ কর্মদিবস ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেটিকে গোপন রেখে ৩০ এপ্রিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হতে আসা আদেশ কপিকে উপেক্ষা করে নথি গোপনের মাধ্যমে অবৈধ ভাবে সেলিম উদ্দিন কবিরাজকে সভাপতি করে সভা আহবান করেন। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেলিম উদ্দিনকে একটি পক্ষ নিয়োগের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন। ফলে সেটিকে জায়েজ করতেই আওয়ামী আমলের সভাপতিকে অভ্যুত্থান পরবর্তী ফ্যাসিস্ট মুক্ত বাংলাদেশে পুনরায় সভাপতি বানানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রোপাগাণ্ডার শিকার হয়েছেন বর্তমান কমিটির সভাপতি ফনির উদ্দিন। স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী মহলে ফনির উদ্দিনের ক্লিন ইমেজ ও দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করায় আওয়ামী লীগের দোসর সেলিম উদ্দিন কবিরাজ ও জসিম উদ্দিন মৃধার পথের কাটা হিসেবে তাকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত। এলাকাবাসী ও কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে, অনেকেই আক্ষেপ করে বলছেন যে ফনির উদ্দিন দূর্নীতি মুক্ত কলেজ গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন তাকে দূর্নীতিবাজরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অসহযোগীতা করে শুধু তাদের ব্যক্তি স্বার্থই হাসিল করছেন না, বরং ঐতিহ্যবাহী কলেজটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন। ই/তা
আপনার জেলার সংবাদ পড়তে