২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে বেশ কিছু ভোগ্য ও গৃহস্থালি পণ্যের ওপর শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধির প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বিটিভিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। এর আগে দিনটিতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাজেট অনুমোদনে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের পাঠানো নির্দেশিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে— বহু পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কমানো হয়েছে কিংবা শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে বাজারে এসব পণ্যের সরাসরি মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে পারে।
কোন কোন পণ্যের দাম বাড়তে পারে?
১. মোবাইল ফোন:
দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন ও সংযোজন খাতে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতির পরিমাণ কমানো হয়েছে। পাশাপাশি আড়াই শতাংশ অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি স্মার্টফোনসহ অন্যান্য মোবাইল ফোনের বাজারমূল্যে পড়বে।
২. হোম অ্যাপ্লায়েন্স:
ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার, আয়রন ও ইলেকট্রিক কেটলির মতো গৃহস্থালি পণ্য উৎপাদনে ভ্যাট ছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং সেসব পণ্যের দামও বেড়ে যাবে।
৩. প্লাস্টিকের তৈজসপত্র:
থালাবাসনসহ গৃহস্থালি প্লাস্টিক সামগ্রীর উৎপাদনে ভ্যাট হার দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক সামগ্রীতে ছাড় থাকবে, তবে অধিকাংশ সাধারণ প্লাস্টিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে।
৪. এলপিজি সিলিন্ডার:
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এলপিজি সিলিন্ডারের ভ্যাট অব্যাহতি কমিয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে রান্নার খরচ কিছুটা বেড়ে যেতে পারে।
৫. বিদেশি চকলেট ও প্রসাধনী:
বিদেশি চকলেটের ক্ষেত্রে শুল্কায়ন মূল্য বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট ১০ ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৪ ডলার। এছাড়া ঠোঁট, চোখ ও মুখে ব্যবহৃত বিদেশি প্রসাধনপণ্যের শুল্কায়ন মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এসব বিলাসী পণ্যের বাজারমূল্য বাড়বে।
৬. ব্লেড ও শেভিং সামগ্রী:
দেশে ব্লেড উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে দাঁড়ি কাটার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচও বেড়ে যাবে।
৭. লিফট ও নির্মাণ সামগ্রী:
লিফট উৎপাদনের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি কমানো হয়েছে। একই সঙ্গে নির্মাণ সংস্থাগুলোর ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
৮. অনলাইন ব্যবসা:
অনলাইনে পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা ডিজিটাল কমার্সে মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে পারে।
৯. কাগজজাত পণ্য ও কলম:
সেল্ফ কপি পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কোটেড পেপারসহ কিছু ছাপাখানার কাগজ এবং বলপয়েন্ট কলমের আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থী ও অফিসপাড়া এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ অনুভব করতে পারে।
১০. ফোর-স্ট্রোক থ্রি-হুইলার:
স্থানীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতি কমানো হয়েছে, ফলে গণপরিবহনে ব্যয় বাড়তে পারে।
বাজেটের আর্থিক পরিসংখ্যান:
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের প্রস্তাবিত আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। এই বাজেটের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যে এই কর-ভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এই ব্যয়বৃদ্ধি বেশ চাপস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।