নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলায় দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য তাদের প্রথম জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে গৃহীত এই বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২৫ শতাংশের সমান।
সোমবার (২ জুন) বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বাজেট বক্তৃতায় এই বাজেট উপস্থাপন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে বাজেট প্রস্তাব অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর শেষে তিনি এই বক্তৃতা দেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায় করবে, আর বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসবে অন্যান্য উৎস থেকে।
প্রত্যাশিত আয়ের তুলনায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এই ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে।
চলতি ব্যয় এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) মিলিয়ে বাজেটের মূল কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। মোট বাজেটের মধ্যে পরিচালন ও অন্যান্য খাতে ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
খাতভিত্তিক বরাদ্দ অনুযায়ী—
• সুদ পরিশোধ: ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা
• বেতন-ভাতা: ৯৭ হাজার কোটি টাকা
• বিদ্যুৎ ও সার খাতে ভর্তুকি: ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা
• সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, “ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং রাজস্ব আদায়ের প্রত্যাশিত হারে না হওয়ার কারণে আমরা বাজেট সংকোচন করতে বাধ্য হয়েছি। তবে এই বাজেট দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।”
তিনি আরও জানান, সরকার ব্যয়ের ক্ষেত্রে সচেতনভাবে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে যাতে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। এটি একটি সংকোচনমূলক বাজেট, যার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, ভ্যাট ব্যবস্থার সরলীকরণ, স্থানীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো, এবং এফডিআই আকৃষ্ট করার নীতিগত দিকগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কর আদায়ে গতি আনা, কর ফাঁকি কমানো এবং ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণের জন্য কিছু আইন ও বিধানের সংস্কার প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৫৪টি বাজেট পেশ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতিতে প্রথম বাজেট পেশ করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মাত্র ৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সেই বাজেট থেকে আজকের ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট—যেটি মূলত রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার এক প্রয়াস।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই বাজেট সংসদের বাইরে ঘোষিত দ্বিতীয় বাজেট। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সংসদের বাইরে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল।